১৪ অক্টোবর ২০১৮, রবিবার, ১০:২২

সরকারের ২ মেয়াদেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা ফেরেনি

ক্ষমতাসীন সরকার টানা দুই মেয়াদে ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়েছে। বর্তমানে দেশে ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ৮২ থেকে ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ পূর্ণাঙ্গভাবে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। অনেকগুলোই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন মানছে না। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৈধভাবে (বিশ্ববিদ্যালয় আইনানুগ) নিয়োগ পাওয়া ভাইস চ্যান্সেলর নেই। নেই প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ট্রেজারার, নিয়মিত অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল বা সিন্ডিকেটের বৈঠকও হয়নি। বছরান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক কার্যক্রমের নিরীক্ষাও হয় না। এরূপ নানা অনিয়ম নিয়েই চলছে উচ্চশিক্ষার মতো বেসরকারি এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বারবার আলটিমেটাম ও সতর্ক করা হলেও কোনো ধরনের শৃঙ্খলা ফেরেনি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলছে, সরকার পুরনো আইনে পরিবর্তন এনে সময়োপযোগী করেছে। আইন মানতে দফায় দফায় তাগিদ দেয়া হয়েছে। পরিদর্শন ও মনিটরিং জোরদার করেছে। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায় থেকে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়াকে সমাধান বিবেচনা করা হয়নি বরং আইনের আওতায় আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

কিন্তু বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে আইন না মানলে অনুমতি বাতিলসহ ক্যাম্পাসে তালা ঝুলানো বা বন্ধ করে দেয়া, ভর্তির ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ নানা হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। এরই আড়ালে ২০১০ সালে আগের আইনের সংশোধনী এনে নতুন করে দলীয় ও রাজনৈতিক পরিচয়ে এবং সরকার ও দলের প্রতি অনুগত উদ্যোক্তাদেরই একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিয়েছে। বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে নতুন অনুমতি দেয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটিও গত প্রায় ১০ বছরে মানসম্পন্ন শিক্ষায় অবদান রাখার সক্ষমতা অর্জন করে আলোচনায় আসতে ব্যর্থ হয়েছে বরং পুরনো বেশ কয়েকটির মতোই নানা অভিযোগের তীর তাদের ব্যাপারে উঠতে শুরু করেছে। সর্বশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আসন্ন নির্বাচনের আগে আর কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে কোনো পদক্ষপ নেয়া হবে না। তবে যেগুলো এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি, তাদের না যাওয়ার কারণ জানতে চেয়ে তাগিদ পত্র দেয়া হবে। এ ছাড়া যাদের নিয়মিত অডিট হয় না তাদেরও একই ধরনের পত্র দেয়া হবে। এতে করে ভোটের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এরূপ মতই উঠে এসেছে বলে বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা নয়া দিগন্তকে নিশ্চিত করেছেন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সাল আইন সংশোধনের পর থেকে অন্তত ছয়বার এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে আলটিমেটাম দিয়েছে। সর্বশেষ দেয়া আলটিমেটামও ২০১৬ সালে জানুয়ারিতে শেষ হয়। এরপর অগ্রগতি পর্যালোচনার করতে গত বছর ৭ মার্চ তারিখে ইউজিসিতে যৌথ বৈঠক হয়। বৈঠকের পর আরো দু’দফা মন্ত্রণালয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাথে শীর্ষপর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সর্বশেষ তাগাদাপত্রের মধ্যেই তৎপরতার ইতি ঘটে।
ইউজি’ির প্রণীত বেসরকারি বিশ্বদ্যালয়গুলোর সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ ও আংশিক শিক্ষাকার্যক্রম নিজস্ব ও স্থায়ী ক্যাম্পাসে চালু করেছে এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হচ্ছে ১৯টি। ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।
এত গেল স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিষয়। মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি তথ্য মতে, প্রায় ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে ভাইস চ্যান্সেলর ছাড়া। ২০টিতে প্রোভাইস চ্যান্সেলর নেই। ৪৪টিতে কোষাধ্যক্ষ বা ট্রেজারার নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিষয় ভিত্তিক শিক্ষক ও গবেষণাগার না থাকা, পর্যাপ্ত ক্লাস না নিয়মিত পরীক্ষা না হওয়াসহ মানসম্পন্ন শিক্ষার ন্যূনতম কোনো নিশ্চয়তা পর্যন্ত নেই। অথচ হাতে কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশের বিরুদ্ধেই সনদ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

স্থায়ী ক্যাম্পাস সম্পর্কে মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে বর্তমানে সরকার ও ইউজিসির অনুমোদনপ্রাপ্ত ১০৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর মধ্যে ৮৪টিতে শিক্ষাকার্যক্রম চালু হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বরের ১৭ মধ্যে ১১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সব শিক্ষাকার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরে ব্যর্থ হলে, ১ জানুয়ারি ২০১৮ থেকে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে পরিচালিত শিক্ষাকার্যক্রমে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখার আলটিমেটাম শেষ হয়। ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, ১২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় দুই যুগ আগে অনুমোদন-অনুমতি পেলেও এখন পর্যন্ত নিজস্ব ও স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তোলেনি। গত ১৬ আগস্ট ২০১৮ ওই ১২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটিকে পৃথক চিঠি দিয়ে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাসে অনুমোদিত শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
এক ধরনের নৈরাজ্যকর উচ্চশিক্ষা পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে গত বছর ৭ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রী-সচিব ও মন্ত্রণালয়ের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অতিরিক্ত সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পূর্ণাঙ্গ কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাল-হকিকত নিয়ে গঠিত যৌথ কমিটি গত বছর ৩০ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়ের কাছে। ওই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই একই বছর ১৬ আগস্ট ১২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে চিঠি দেয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, ওই ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিই প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাচ্ছে না। জমি ক্রয় করলেও এখন পর্যন্ত তারা স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য কোনো পদক্ষেপ শুরুই করেনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে গত বছর ১৬ আগস্টে চিঠি দিয়ে সর্বশেষ আলটিমেটাম দিয়েছে।
উল্লেখ্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সাত বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার বিধান রয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে অনুমতিপ্রাপ্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার জন্য এক একর অখণ্ড জমি থাকতে হবে এবং সেখানেই সব শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হবে। এ দু’টি মেগাসিটির বাইরে যে কোনো জেলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা ও পাঠদান করতে হবে দুই একর নিজস্ব অখণ্ড জমির ওপর। কিন্তু অনুমতিপ্রাপ্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো আইনের এ শর্ত শতভাগ পূরণ করছেন না।

 

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/356874