১৩ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ১০:৩৭

সড়কে শৃঙ্খলা আর কবে

আগায় পানি ঢাললেও গোড়ায় পড়েনি হাত

কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। শৃঙ্খলা ফিরছে না সড়ক-মহাসড়কে। গত দুই মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার তদারকিতেও বিশৃঙ্খলা দূর হয়নি। অসংখ্য মামলা ও বিপুল জরিমানার পরও নৈরাজ্য রয়ে গেছে আগের মতোই। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা সমকালকে বলেছেন, নৈরাজ্য বন্ধে গোড়ায় হাত দেওয়া হয়নি। আগায় পানি ঢালা হয়েছে। তাই ফল মেলেনি।

গত কয়েক দিন রাজধানীতে সরেজমিন দেখা গেছে, হেলমেটপরা মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর সংখ্যা বাড়লেও বাকি সব আগের মতোই বিশৃঙ্খল রয়ে গেছে। বিপজ্জনক ওভারটেকিং বন্ধ হয়নি। যাত্রী পেতে বাসে বাসে রেষারেষি চলছে আগের মতোই। ফিটনেসবিহীন গাড়ি আবার রাস্তায় ফিরেছে। বাস চলছে চুক্তিতে। বন্ধ হয়নি যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা, রাস্তা পারাপার। দখলমুক্ত হয়নি সড়ক ও ফুটপাত, যেখানে সেখানে পার্কিং হচ্ছে আগের মতোই। সরেজমিন মতিঝিল ও গুলিস্তান এলাকায় দেখা যায় রাস্তার দুই পাশে গাড়ির সারি, ফুটপাতে দোকানপাট।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের ফিটনেসবিহীন বাসের চাপায় নিহত হয় শিক্ষার্থী দিয়া খানম মীম ও আবদুল করিম রাজীব। তাদের মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। নজিরবিহীন আন্দোলনে নড়চড়ে বসে সরকার। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। গত ৫ আগস্ট থেকে ১০ দিনের ট্রাফিক সপ্তাহ পালন করা হয়। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ট্রাফিক সচেতনতা মাসের ঘোষণা দেয়। তবে টানা এক মাসের অভিযানে উন্নতি সামান্যই ঘটেছে।

এর আগে গত ১৬ ডিসেম্বর ১৭ দফা নির্দেশনা জারি করা হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। বাসে চালকের লাইসেন্স ও মোবাইল নম্বর দৃশ্যমান স্থানে লাগানো, নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া বাসের দরজা বন্ধ রাখা, জেব্রাক্রসিং দৃশ্যমান করা, সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত রাখা, ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল চালু, ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ ও ধ্বংসের নির্দেশনা দেওয়া হয়। অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয় কমিটি। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, ফার্মগেট পুলিশ বক্সের কাছে ভিড় করে আছে কিছু মানুষ। মহাখালীমুখী সড়কে যান চলাচল কমে এলে তারা দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। কারও কারও অতক্ষণও থেমে থাকার ধৈর্য নেই। তারা চলন্ত যানবাহনের মধ্যেই হাত তুলে যান থামিয়ে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন। অথচ ফার্মগেট এলাকায় স্বল্প দূরত্বে রয়েছে তিনটি ফুট ওভারব্রিজ। বাংলামটরের ফুট ওভারব্রিজ ও কারওয়ান বাজারের আন্ডারপাস ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দেখা যায় আগের মতোই অনাগ্রহী পথচারীরা। নির্ধারিত তারিখের পর দুই পক্ষ পেরিয়ে গেলেও স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যকর হয়নি, গাড়ি চলছে পুলিশের হাতের ইশারায়।

ট্রাফিক সচেতনতা মাসে ঢাকা মহানগর পুলিশের নির্দেশনা ছিল, যেখানে-সেখানে বাস থামিয়ে যাত্রী নেওয়া যাবে না। স্টপেজ ছাড়া বাসের দরজা বন্ধ রাখতে হবে। ঘোষণা ছিল, ১৩০টি বাসস্টপেজ চিহ্নিত করার। নগরবাসীকে সচেতন করতে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রোভার স্কাউট ও গার্লস গাইডের সদস্যরাও রাস্তায় কাজ করেন তখন।

কিন্তু বন্ধ হয়নি ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল। ট্রাফিক সচেতনতা মাসে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর জাহাঙ্গীর গেট এলাকায় ভিআইপি ২৭ নম্বর পরিবহনের বাসের (ঢাকা মেট্রো ব- ১১-৭১৩৬) চাপায় নিহত হন একাত্তর টেলিভিশনের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। বাসটির ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের জুনে।

ডিএমপি সূত্র জানায়, ট্রাফিক আইন অমান্যের ঘটনায় সেপ্টেম্বর মাসে মোট এক লাখ ৭২ হাজার ৬০০টি মামলা করা হয়েছে। ফিটনেস না থাকায় সাত হাজার ৬২৮, রুট পারমিট না থাকায় ছয় হাজার ৪৯৫, ড্রাইভিং লাইসেন্স-সংক্রান্ত ৩০ হাজার ৫৬৪, উল্টোপথে গাড়ি চালানোয় ১৩ হাজার ৮৮, মোটরসাইকেল চালানোয় ৬৫ হাজার ৮০৩টি মামলা হয়। ভিডিও মামলা হয় ১৯ হাজার ৩০৪টি। এই এক মাসে ১৪ কোটি ১৯ লাখ ৪৭৯ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।

এত মামলা-জরিমানার পরও ফল মেলেনি। নৈরাজ্য যা ছিল, তাই রয়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মোয়াজ্জেম হোসেন সমকালকে বলেন, সমস্যার গোড়ায় হাত দেওয়া হয়নি। আগায় পানি ঢালা হয়েছে। সড়ক নিরাপদ করতে গোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। এনফোর্সমেন্ট (মামলা, জরিমানা) তার একটি মাত্র অংশ। বিশদ পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও নজরদারি থাকতে হবে। আন্দোলনের মুখে পরিকল্পনা ছাড়াই তড়িঘড়ি অভিযান চালানো হয়েছে। ফল পাওয়া যাবে না জেনেই অভিযান হয়েছে।

সড়ক প্রাণঘাতী হয়ে ওঠার জন্য দায়ী করা হয় বাসে বাসে রেষারেষি ও বিপজ্জনক ওভারটেকিংকে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর জন্য দায়ী চুক্তিভিত্তিক বাস চলাচল। এ পদ্ধতিতে মালিক নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে চালককে বাস দেন। মালিকের চুক্তির টাকা ও অন্যান্য খরচ মেটানোর পর যা থাকে, চালক পান সেই উদ্বৃত্ত টাকা। চালক তাই খরচ তুলতে চাপের মধ্যে থাকেন। চুক্তিতে বাস চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদ। গত ২৪ আগস্ট পরিষদের সভা থেকে ২০ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। এর আগে মালিক সংগঠনই চুক্তিতে বাস চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। চুক্তিতে বাস চলাচল বন্ধে তারা অভিযানও চালায়।

কিন্তু সরেজমিন দেখা গেছে, এ অনিয়ম বন্ধ হয়নি। কাউন্টার সার্ভিস ছাড়া অন্যান্য বাস এখনও চুক্তিতে চলছে। সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কথা হয় হেমায়েতপুর-সায়েদাবাদ রুটের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-২৩৯৯) চালক হোসেন মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, আগের মতোই চুক্তিতে বাস চালাচ্ছেন। মালিককে চার হাজার টাকা দিতে হয় প্রতিদিন। সরকারি নির্দেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'তারা তো খালি ঘোষণাই দেয়। মালিক তো কন্ট্রাক্ট (চুক্তি) ছাড়া বাস দেয় না।'

এসব প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, বহু বছর ধরে অনিয়ম চলছে। তা দুই-এক মাসে বন্ধ হবে না। সময় লাগবে।

রাজধানীতে ২৭৯টি রুটে ২৪৬টি কোম্পানির বাস চলে। মাত্র ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের ঢাকা শহরে এত রুট ও কোম্পানির বেড়াজালও দুর্ঘটনার কারণ বলে মনে করেন ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোথাও এমন বিশৃঙ্খল ব্যবস্থা নেই।

বাসে বাসে রেষারেষি বন্ধে 'বাস রুট রেশনালাইজেশন' পদ্ধতি চালু করার পরিকল্পনা অনেক আগের। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন। সম্প্রতি সরকার এ দায়িত্ব দিয়েছে দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকনকে। কমিটির সদস্য এস এম সালেহ উদ্দিন। তিনি সমকালকে বলেন, রুটের সংখ্যা ছয়টিতে নামিয়ে আনতে হবে। প্রতিটি রুটে একটি মাত্র কোম্পানির বাস চলবে। এ পদ্ধতি চালু ছাড়া আর সমাধান নেই। বহুদিন ধরে তারা এ চেষ্টা করছেন। কয়েক বছর আগে বিস্তারিত পরিকল্পনাও হয়েছে। কিন্তু কাজ এগোচ্ছে না।

দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এক মাসেই ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা পাল্টে দেওয়া যাবে- বিষয়টি এমন নয়। তবে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। মোটরসাইকেল চালক-আরোহীদের হেলমেট পরার হার এখন প্রায় ৯০ ভাগ। বাসের দরজাও বেশিরভাগ বন্ধ থাকছে। উল্টোপথে গাড়ি চালানো বা ট্রাফিক নির্দেশনা অমান্যের ঘটনাও অনেকটা কমেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার উপকমিশনার মাসুদুর রহমান সমকালকে বলেন, মাসব্যাপী ট্রাফিক সচেতনতা কার্যক্রমে আশানুরূপ ফল মেলেনি। তবে লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে চলেছে পুলিশ। সড়কে শতভাগ শৃঙ্খলা না ফেরা পর্যন্ত এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।

ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার ও বাংলামটর এলাকায় দেখা যায়, নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়াও রাস্তার বিভিন্ন স্থানে থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে বাসগুলোতে। রাস্তার পাশ থেকে কেউ ইশারা করলেই বাস থামছে। পালকি, এলাইক, বিআরটিসি ও ট্রাস্ট পরিবহনের বেশ কয়েকটি বাসের দরজা খোলা থাকতে দেখা যায়। ইউ-টার্ন নেওয়া নিষেধ হলেও অনেক যানচালক তা মানছেন না। ফার্মগেট মোড়ে মহাখালী থেকে আসা একটি প্রাইভেট কারকে এমন ইউ-টার্ন নিতে দেখা গেল। সাধারণভাবে পারাপারের সুযোগ নেই এমন কিছু স্থানে সড়ক বিভাজকের কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন কেউ কেউ। তবে মূল সড়কে হিউম্যান হলার চলাচল প্রায় বন্ধ বলে জানা গেল।

ফার্মগেট এলাকায় কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, ট্রাফিক সচেতনতা কার্যক্রম সমাপ্ত হয়েছে। ট্রাফিক পরিদর্শক খাদেমুল ইসলাম বলেন, পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে এক মাসের কার্যক্রম আশাব্যঞ্জক। তবে শুধু পথচারী বা যানচালকের ওপর সব কিছু চাপিয়ে দিলে হবে না। পথচারীর হাঁটার মতো ফুটপাত আছে কি-না কিংবা সড়কের অনির্ধারিত স্থানে পারাপারের সুযোগ বা প্রয়োজন থাকবে কেন- সে বিষয়েও ভেবে দেখতে হবে। আসলে সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা না হলে কার্যকর সুফল মিলবে না।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী সমকালকে বলেন, নৈরাজ্য দূরের ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে। একটি ঘটনা ঘটলে অনিয়ম রোধে তোড়জোড় হয়। উত্তেজনা থিতিয়ে এলে আবার বিশৃঙ্খলা ফিরে আসে।

 

http://samakal.com/bangladesh/article/1810757