১৩ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ১০:৩০

বিদেশী আগ্রাসনের কবলে পোল্ট্রি শিল্প

অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে দেশের পোল্ট্রিশিল্প। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের দৌড়াত্বে সম্ভাবনাময় এ শিল্পে দেশী উদ্যোক্তারা অস্তিত্ব হারাতে চলছে। দেশে যে কয়েকটি শিল্পের নীরব বিপ্লব ঘটেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পোল্ট্রি শিল্প। বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের ব্যবসায় নিয়োজিত বিদেশী কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্যে বিপাকে পড়েছে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে ৭টি বিদেশী কোম্পানি সরকারের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পের ব্যবসা করছে। সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকার সুযোগে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা পোল্ট্রি শিল্পে কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তার করছে। ইতোমধ্যে শিল্পের প্রায় ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বিদেশী ৭টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে পাঁচটি ভারতীয়। এদিকে বিদেশী কোম্পানীগুলো ৩ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণে ব্যবসার সুযোগ পেলেও দেশীয় ব্যবসায়ীরা ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছে। তবে ব্যাংক ঋণের সুবিধাও পাচ্ছে কেবল বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। আর ঋণ সুবিধা না পেয়ে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামার এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আরো অনেকগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এ জন্য লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির দাবি জানিয়েছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। কিন্তু এই সাতটি বিদেশী কোম্পানি বাংলাদেশে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবে কিংবা কী পরিমাণ লভ্যাংশ নিয়ে যেতে পারবে তার সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। ফলে বিদেশী কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাজার দখলের কারণে দেশীয় কোম্পানিগুলো বাজার হারাচ্ছে। পাশাপাশি পোল্ট্রি শিল্পে ব্যাংক ঋণ সুবিধা থাকলেও সেই সুবিধা পাচ্ছে কেবল বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। আর ঋণ সুবিধা পাচ্ছে না ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামার।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সূত্র বলছে, বাংলাদেশের পোল্ট্রি ব্যবসার ৪০ শতাংশ ইতোমধ্যে বিদেশী ৭টি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বিদেশী সাতটি কোম্পানি হলো ভিএইচ গ্রুপ, গোদরেজ, সেগুনা, টাটা, অমৃত গ্রুপ, সিপি এবং নিউ হোপ। কোম্পানিগুলোর কেউ বাচ্চা উৎপাদন, ডিম উৎপাদন কিংবা মুরগি উৎপাদনের অনুমতি নিয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিদেশী কোম্পানিগুলো বর্তমানে সবই করছে। ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো বাজার হারাচ্ছে। এছাড়া বিদেশী কোম্পানিগুলো সর্বোচ্চ কী পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে পারবে, মোট লভ্যাংশের কত শতাংশ নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারবে এবং কত শতাংশ এদেশে খরচ কিংবা বিনিয়োগ করতে পারবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই। বিদেশী পুঁজি আসার কারণে দেশী ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে। বড় পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র খামারিরা। এসব সঙ্কটে ২০২১ সালের মধ্যে বিনিয়োগের লক্ষ্য অর্জন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া আরও কিছু বিদেশী প্রতিষ্ঠান ব্যবসার জন্য পাইপলাইনে রয়েছে। কয়েকদিন আগেও যেখানে দেশীয় ১লাখ থেকে দেড় লাখ খামারি ছিল। বর্তমানে তা ৭০ হাজারে নেমে এসেছে। ২০০৭ সালে খামারির সংখ্যা ছিল দেড় লাখের বেশি। এছাড়া খামারিদের ব্যয়ের ৭০ শতাংশই যায় পোল্ট্রি ফিডে, যা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এই আমদানিতে ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা না পাওয়ায় আরও বিপাকে রয়েছে পোল্ট্রি শিল্প। অপরদিকে লাইভ স্টোক ডিপার্টমেন্ট থেকে অনুমতি না নিয়ে বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট থেকে অনুমতি নিয়ে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করছে। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, এ খাতের কোন সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ও নীতিমালা নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে পর্যায়ক্রমে পুরো পোল্ট্রি শিল্পই বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। বাংলাদেশের যে সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি শিল্পে জড়িত রয়েছে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। কারণ, বিদেশী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানের নেই। বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং ব্যক্তি পর্যায়ের খামারিরা বিপাকে পড়বে। তাদের মতে, এই শিল্পে বিদেশী আগ্রাসন বাড়লেও সরকারের নজর নেই। নেই বাজারের নিয়ন্ত্রণও। একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, এই শিল্প অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ছে দিন দিন। কারণ আজ পর্যন্ত এই শিল্পের কোন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে পাওয়া যায়নি।
সূত্র মতে, ২০০৮ সালে প্রণীত নীতিমালায় পোল্ট্রিকে প্রাণিজ কৃষিখাত ঘোষণা দিয়ে এ শিল্পে শস্যখাতের সমান সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়। যা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। অথচ দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অবদান রাখছেন দেশীয় খামারিরা। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) মতে, ২০০৭ সালের দিকে দেশে প্রায় দেড় লাখ পোল্ট্রি খামার থাকলেও গত ১০ বছরে অর্ধেকেরও বেশী কমে বর্তমানে ৬৫ হাজারের মতো খামার টিকে আছে। এছাড়াও আছে ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি, মুরগির খাবার তৈরির কারখানা। পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিংকেজ শিল্প, কাঁচামাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। জাতীয় অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ।

সংস্থাটি জানায়, বর্তমানে ৭টি বিদেশী কোম্পানি সরকারের অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। এর মধ্যে ৫টিই ভারতের। কোম্পানিগুলো হচ্ছে, ভিএইচ গ্রুপ, গোদরেজ, সেগুনা, টাটা এবং অমৃত গ্রুপ। এছাড়া থাইল্যান্ডের সিপি এবং চীনা প্রতিষ্ঠান নিউ হোপ দাপটের সঙ্গে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। এসব বড় কোম্পানি ব্যাংক ঋণ সুবিধা পেলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি কোম্পানিগুলো ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে ভবিষ্যতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর কাছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি দেশী কোম্পানিগুলো জিম্মি হয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

মুনাফা কম, খাদ্যপণ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি, আড়তদারদের হাতে ডিমের বাজার জিম্মি হওয়া ও ব্যাংকঋণের অপ্রতুলতাসহ নানা কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি শিল্প। বিশেষ করে ক্ষুদ্র খামারিদের এখন অস্তিত্ব নিয়ে টানাপোড়েন দশা। নতুন করে এ ব্যবসায় কেউ বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছেন না। এ পেশায় জড়িত খামারিদের অনেকেই বর্তমানে বিকল্প ব্যবসার সন্ধান করছেন। যারা কোনমতে টিকে আছেন, তারাও কয়েক বছর ধরে লাভের মুখ দেখছেন না। আবার অনেকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ার ভয়ে হঠাৎ করে খামার বন্ধ করতেও পারছেন না। পোল্ট্রি খামারি, ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার ইসলাম পোল্ট্রি খামারের মালিক বলেন, আমার আগে পোল্ট্রি খামার ছিলো। কিন্তু ব্যাংকে বিভিন্ন সময় আবেদন করেও ঋণ পাইনি। যার কারণে ডিলারদের কাছ থেকে বাকিতে মুরগির বাচ্চা, খাবার ও মেডিসিন কিনতে হয়েছে। ঋণ সুবিধা পেলে ডিলারদের কাছ থেকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হতো। লোকসানেও পড়তে হতো না। এখন ফার্ম তুলে দিয়ে ফার্মের্সি ব্যবসা করার চিন্তা করছি।

কসবার মইনপুর গ্রামের এআরএফ এগ্রো ফার্মের মালিক আব্দুর রহমান বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে খামার দিয়েছিলাম। কিন্তু ভ্যাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেটা বেশি দিন টিকে কিনা বলতে পারছি না। এভাবে ব্রাক্ষমবাড়িয়াসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চলের ক্ষুদ্র খামার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। জানা যায়, বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে পোল্ট্রি খামার শুরু হয় ১৯৬৬ সালের দিকে। বর্তমানে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে ওঠা প্রথম পোল্ট্রি খামার ‘এগ এন্ড হেনস লি’ কিনে নেয় থাইল্যান্ডের সিপি কোম্পানি। বর্তমানে চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিরাজগঞ্জসহ দেশের ১৮টিরও অধিক স্থানে নিজস্ব খামার, হ্যাচারি ও ফিডমিল স্থাপন করেছে সিপি। সুগুনা কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে ফরিদপুর ও রাজবাড়ী জেলার রাজ পোল্ট্রি, গোল্ডেন চিকসসহ ১০টিরও অধিক খামারে। কোম্পানিটি ইতোমধ্যে ১৫টিরও বেশি দেশীয় কোম্পানি লিজ নিয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য বিদেশী কোম্পানিগুলোও তাদের ব্যবসা বড় করতে কাজ করে যাচ্ছে।

দীর্ঘদিন যাবৎ পোল্ট্রি শিল্পের আয় করমুক্ত ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে এ শিল্পের কর অব্যহতি সুবিধা তুলে নিয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। চলতি অর্থ বছরেও তা অব্যাহত আছে। বর্তমান সময়ে এ সেক্টরে যে পরিমাণ ট্যাক্স আরোপিত হয়েছে এতে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে রোগ ও প্রাকৃতিক বৈপরীত্বের কারণে অনেক খামারেই লোকসান হয়। ফলে ছোট ও মাঝারি খামারগুলো উৎপাদনে টিকে থাকতে পারে না। এমতাবস্থায় পোল্ট্রি খামারগুলো কর অব্যাহতির কাল বৃদ্ধি করে এদের উৎপাদনে ও নতুন খামার স্থাপনে উৎসাহিত করা উচিত। এজন্য বাণিজ্য ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিষয়গুলো বিশেষ করে ভ্যাট, ট্যাক্সসহ আলোচিত সমস্যাবলি আন্ত:মন্ত্রণালয় জরুরি বৈঠকের মাধ্যমে অতি দ্রুত সমাধান করতে হবে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশনের সূত্র মতে, ১৯৮০ সালের দিকে বাণিজ্যিকভাবে পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ হয়। দেশে প্রাণীজাত প্রোটিনের বড় যোগানদাতা এখন পোল্ট্রি শিল্প। মোট চাহিদার শতকরা ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ প্রোটিন আসে পোল্ট্রি থেকে। পোল্ট্রি শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ জড়িত বলে উল্লেখ করেন তিনি। পোল্ট্রি খাতের প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশে উন্নীত করা হবে উল্লেখ করে, তারা বলেন, বর্তমানে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ। ২০২১ সালের মধ্যে এ হার ২০ শতাংশে পৌঁছবে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্পে লেনদেন হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার ৪২ কোটি টাকা। শহর ও নগর থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পুষ্টি চাহিদারও বিরাট একটি অংশ পোল্ট্রির মাধ্যমেই পূরণ করা যাচ্ছে। পাশাপাশি রপ্তানিতেও নজড় দেয়া হচ্ছে। এমন অবস্থায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়ার পরিবর্তে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে সরকারের সহযোগিতা এবং পোল্ট্রি শিল্পের জন্য আমদানকৃত খাদ্যে ভ্যাট প্রত্যাহার করা হলে শিল্পটি দেশে নীরব বিপ্লব ঘটাতে পারে। কারণ, এ শিল্পের জন্য শহুরে দামী জমি বা শিল্প প্লটের দরকার পড়ে না। ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোক্তারা এমনকি গ্রামে তাদের নিজেদের বাড়ির আঙ্গিনাতেই খামার তৈরি করে নিতে পারে। কিন্তু সব সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ব্যাংক ঋণসহ সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার কারণে। অন্যদিকে রয়েছে বিদেশী কোম্পানিগুলোর অনিয়ন্ত্রিত কর্মকান্ড। অনেক বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করে সক্ষমতার দিক থেকে তারা শুধু দেশি খামারিদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে না, টাকার জোরে বাজারও দখল করে নিচ্ছে।
তথ্য অনুযায়ী, পোল্ট্রি উৎপাদনে যে খরচ হয় তার ৬৮ শতাংশ খাদ্য খরচ, ১৮.৫ শতাংশ বাচ্চা কেনার খরচ, ৫ শতাংশ ওষুধের খরচ, ৪ শতাংশ শ্রমিকের মজুরি এবং বাকি অন্যান্য খরচ। বর্তমানে এসব খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সারাবিশ্বে পোল্ট্রি খাদ্যের অন্যতম উপকরণ ভুট্টার উৎপাদন কমায় দাম বেড়েছে। বর্তমানে প্রয়োজনীয় ভুট্টার ৪০ শতাংশই আমদানি করতে হয়। এর ওপর আবার বসানো হয়েছে অগ্রিম আয়কর, যার কারণে বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া পোল্ট্রি শিল্পের কাঁচামাল সয়াবিন মিল ও ওয়েল কেকের ওপর যথাক্রমে ১০ ও ৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পোল্ট্রি খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। ব্যবসায়ীরা জানান, দীর্ঘদিন যাবত পোল্ট্রি শিল্পের আয় করমুক্ত ছিল। কিন্তু ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে এ শিল্পের কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে নিয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। চলতি অর্থবছরেও তা অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, গার্মেন্টস শিল্পের পর কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছে পোল্ট্রি শিল্প। বিদেশী কোম্পানিগুলো ৩ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণ সুবিধা পাচ্ছে আর দেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা নিতে হচ্ছে। এই বৈষম্য দূর করতে হবে দেশী পোল্ট্রি খামারগুলোকে বাঁচাতে হলে। এবং বিদেশী কোম্পানিগুলোকে অধিদতরের অধীনে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, এ খাতে নিরব বিপ্লব ঘটছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। অথচ এই খাতে সরকারের নজড় নেই। তিনি এ খাতের উন্নয়নে এবং বিদেশী জিম্মিদশা থেকে বের হতে পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানান। অন্যথায় ভবিষ্যতে এই শিল্প বিদেশীদের দখলে চলে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। মসিউর রহমান বলেন, ব্যক্তি পর্যায় থেকে এ শিল্পকে অনেক উপরে নিয়ে আসা হয়েছে। সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে বার বার বলা হলেও কোন সহায়তা না পাওয়ায় আমরা হতাশ। তাদেরকে বুঝাতে পারছিনা। তাই এখনই পদক্ষেপ না নিলে একটি সময় আসবে যখন আমরা পিছিয় যাবো বলে উল্লেখ করেন তিনি। ‘সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পোল্ট্রি শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে মুরগির ডিম ও মাংসই প্রাণিজ আমিষের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা।’

সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে মুরগির গোশতের দৈনিক উৎপাদন প্রায় ৪হাজার মেট্রিক টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় দুই কোটি ৮০ লাখ। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় এক কোটি ৬৮ লাখ। পোল্ট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ৬০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ফিড মিলে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৯৫ ভাগ ফিড। মুরগির বিষ্টা দিয়ে এখন বায়োগ্যাস ছাড়াও তৈরি হচ্ছে জৈব সার। অবশ্য পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ ও সফলতার পেছনের গল্পটি কষ্ট, সাধনা আর অসীম ত্যাগের। ২০০৭, ২০০৯ এবং ২০১১ সালে বার্ড ফ্লু’র ভয়াবহ সংক্রমণে এ শিল্পের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রায় ৫০ শতাংশ খামার বন্ধ হওয়ার পরও এ শিল্পের অগ্রগতি থেমে থাকেনি। বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত শ্রম সাধনায় এসেছে সাফল্য, ঘটেছে নীরব বিপ্লব। আশার খবর হলো, সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০২১ সালের মধ্যে বছরে ১৫০০ কোটি ডিম ও ২০ লাখ মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদনের স্বপ্ন দেখছে শিল্পটি। যা পূরণ করতে এ খাতে কমপক্ষে ৬০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রয়োজন পড়বে। এই বিনিয়োগ নিশ্চিতে সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংক ঋণের সুদ, বীমার আওতায় পোল্ট্রি খাতকে নিয়ে আসা ও সরকারি সহায়তা দেয়ার সুপারিশ খাত সংশ্লিষ্টদের।

http://www.dailysangram.com/post/349101