১৩ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ১০:২৯

সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বাড়ছে গ্যাস সিলিন্ডারের দাম

অব্যাহত গ্যাস সংকট এবং দীর্ঘ দিন ধরে গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ থাকায় বেড়েছে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার। বাধ্য হয়ে অনেকে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছে। গ্রাহক বেড়ে যাওয়ায় সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার যেমন বাড়ছে তেমনি বেড়েছে বেসরকারি উদ্যোগে বাজারজাত। ফলে সিলিন্ডার গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেট। তারা বিভিন্ন অজুহাতে গ্যাস সিলিন্ডারের দাম বাড়িয়ে থাকে নিজেদের ইচ্ছেমতো।

গত মাসে (সেপ্টেম্বর) সাড়ে ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম ছিল ১ হাজার টাকা। ৩০ কেজি ওজনের সিলিন্ডার বিক্রি হয়েছিল সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০০ টাকায়। কোনো কোনো কোম্পানি এর চেয়ে কম দামেও এলপি গ্যাস বিক্রি করেছিল। কিন্তু ১ অক্টোবর থেকে ছোট-বড় সব সিলিন্ডারের দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার এখন বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২৫০ এবং ৩০ কেজির সিলিন্ডার ৩ হাজার টাকায়। দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে কোম্পানিগুলো বলছে, এতদিন তারা লোকসানে এলপি গ্যাস বিক্রি করত। লোকসান কমাতেই দাম কিছুটা সমন্বয় করা হয়েছে।
দেশে এলপি গ্যাস বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম ওমেরা ফুয়েলস লিমিটেডের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দাম বাড়ানো হয়েছে। আমরা এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের বিপরীতে লোকসান দিয়ে আসছিলাম। এখন এটা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দর না বাড়িয়ে উপায় নেই। তারপরও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পুরোপুরি সমন্বয় করা হয়নি। এখনো আমাদের লোকসান হবে। তবে পরিমাণটা একটু কমে আসবে।

এদিকে এলপি গ্যাসের হঠাৎ এ দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা। রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে দীর্ঘদিন ধরে এলপি গ্যাস ব্যবহার করছে হ্যাপি ফুড অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। পাইপলাইনের গ্যাস না পাওয়ায় সিলিন্ডার গ্যাস দিয়েই চলে রেস্টুরেন্টের যাবতীয় রান্নার কাজ। তবে এলপি গ্যাসের বড় সিলিন্ডারের দাম হঠাৎ ৫০০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এ ব্যবসায়ী।
রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক মো. মনির বলেন, খরচ ওঠাতে গিয়ে খাবারের দাম বাড়ালে কাস্টমার হারাতে হচ্ছে। কারণ আগে যে খাবার কাস্টমার ৮০ টাকায় খেতেন এখন তার দাম ১০০ টাকা করলে অনেকেই আসতে চাইবেন না। সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার এলপি গ্যাসের অন্য ভোক্তারাও।
যাত্রবাড়ীর কুতুবখালি এলাকার হোটেল মালিক আফসার জানান, এমনিতেই ব্যবসার অবস্থা ভালো না। এখন আবার সিলিন্ডারের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে আমরা লাভ করবো কি ? দোকান ভাড়া বেচা বিক্রি করে এখন সংসার চালানোই দায়।
গ্যাস সংকটের কারণে বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। এতে এলপি গ্যাসের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে দেশে এলপি গ্যাসের চাহিদা বছরে তিন লাখ টন। ২০১৫ সালে দেশে মোট এলপি গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ ছিল দুই লাখ টন। তবে জ্বালানি বিভাগ বলছে, প্রকৃতপক্ষে এলপি গ্যাসের চাহিদা পাঁচ লাখ টনের মতো।

এলপি গ্যাসের এ চাহিদার মাত্র ৮ শতাংশ জোগান দেয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সহযোগী প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেড। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানের সাড়ে ১২ কেজি ওজনের প্রতি সিলিন্ডার এলপি গ্যাসের মূল্য ৭০০ টাকা। ২০০৯ সাল থেকে এ দামেই এলপি গ্যাস বিক্রি করছে তারা।
তবে এলপি গ্যাসের চাহিদার ৯২ শতাংশই জোগান দিচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে প্রায় ২০টি বেসরকারি এলপি গ্যাস কোম্পানি রয়েছে। কোম্পানিগুলো নিজেদের মতো করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। তবে প্রতিটি কোম্পানিকে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছ থেকে লাইসেন্স নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এনার্জিপ্যাকের (জি-গ্যাস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলেন, সাড়ে ১২ কেজি ওজনের প্রতি সিলিন্ডারে অনেক কোম্পানিকে ১২০ টাকা পর্যন্ত ভর্তুকি দিতে হচ্ছিল। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পর এখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে এ গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এছাড়া ইস্পাতের মূল্যবৃদ্ধিতে সিলিন্ডারের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। প্রতিযোগিতার কারণে এর সমান্তরালে গ্যাসের দাম বাড়ছে না।

এদিকে এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। এতে সিন্ডিকেট করে বাজারে প্রভাব ফেলছে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। তারা যে দাম নির্ধারণ করছে, সে দামেই কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে কোম্পানিগুলো এলপি গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। বিষয়টি আমরা পর্যালোচনা করে দেখছি দাম কত বাড়তে পারে। আমরা যে কোম্পানিগুলোকে রেগুলেট করব, তার জন্য তো একটা নীতিমালা দরকার। কিন্তু এখন রেগুলেট করার মতো কোনো নীতিমালা নেই।
এদিকে শুধু ঢাকাই নয় দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাস সিলিন্ডারের দাম নিয়ে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সোনারগায়ের মোগরাপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী মাসুম মাহমুদ জানান, এক মাসের ব্যবধানে যদি প্রতিবোতল গ্যাসের দাম ৫টাকা বেড়ে যায় তাহলে আমাদের ব্যবসা ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। হোটেলে বড় বোতল গ্যাস মাত্র কয়েকদিন যায়। আমরা নতুন গ্যাস সংযোগ পাইনা আবার সিলিন্ডির গ্যাসের দাম লাগামছাড়া বাড়ছে । এর একটা সমাধান প্রয়োজন।
এলপি গ্যাসের দাম নিয়ে গ্রাহকের অভিযোগ সম্পর্কে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে একটি নীতিমালা করে তা কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই নীতিমালা কার্যকর হলে আর কোনো অভিযোগ থাকবে না বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাসাবাড়ি ও পরিবহন খাতে ব্যবহার করা গ্যাসের ২০ শতাংশ অপচয় হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি এলপিজি ব্যবহার করি তাহলে ২০ শতাংশ সাশ্রয় হবে। এ জন্য বর্তমান সরকার বাসাবাড়ি ও পরিবহন খাতে এলপিজিকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে। নসরুল হামিদ বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির আকার বাড়ছে। সে ক্ষেত্রে গ্যাস ও বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। তাই কলকারখানা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ছাড়া অন্য সব খাতে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে আনা হবে।৭০ ভাগ আবাসিক জ্বালানির চাহিদা এলপিজি থেকে পূরণের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে বলে জানান তিনি।

http://www.dailysangram.com/post/349097