১৩ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ১০:২৮

চামড়া শিল্পের আর্ন্তজাতিক বাজার হারাচ্ছে বাংলাদেশ

শিল্প নগরী স্থানান্তর নিয়ে জটিলতা আর বিশ্ব বাজারের দরপতনে দেশের চামড়া শিল্পের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে আর্ন্তজাতিক বাজারে। টানা কয়েক বছর ধরে কমছে রপ্তানি আয়। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না নিলে ২০২১ সালের মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা রপ্তানি আয়ের সরকারি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সম্ভাবনা কম বলে শঙ্কা চামড়া খাত সংশ্লিষ্টদের।

নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয় চামড়া। যার বেশিরভাগই প্রস্তুত করা হয় বিদেশে রপ্তানির জন্য। তবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসেবে, গত কয়েক বছরে দুর্বল হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত হিসেবে বিবেচিত চামড়া শিল্প।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১৩৮ কোটি ডলারের বিপরীতে আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ কম। আর এর আগের অর্থবছরের তুলনায় এ হার ছিল ১২ শতাংশ কম। চলতি অর্থবছরে এই খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২৮ কোটি ডলার। তবে সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণেও রয়েছে সংশয়।
ট্যানারি মালিকরা বলছেন, ২ বছরেও সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে প্রত্যাশা অনুযায়ী সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেনি বিসিক। সেই সঙ্গে দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধ। ফলে বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কায় তারা।
জানা গেছে,পরিবেশ দূষণের অভিযোগে হাজারি বাগ থেকে ট্যানারি শিল্পকে সাভারে স্থানান্তর করে। কিন্তু সাভারে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের কাজ শেষ না কওে কারখানা স্থনান্তর করে। এখই সাথে গ্যাস সংযোগ সময় মত পায়নি তারা। শুধু তাই নয় হাজারিবাগে ২০৫ টি কারখানা থাকলেও সাভারে প্লট পেয়েছে মাত্র ১৫০ টি। বাকি ৫৪ টি কারখানার মালিক কোন প্লট পায়নি। এতে করেও এসব কারখানার শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়ে।

নিদিষ্ট সময়ে ঋণ না পাওয়া এবং নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়াতে কারখানা স্থনান্তরের পরেও অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে পারেনি। এতে করে কয়েক হাজার কোটি টাকা রফতানি অর্ডার বাতিল হয়ে যায়। এতে করে এ খাতে রফতানি অনেক কমে যায়।
বুড়িগঁঙ্গাকে বাঁচাতে সাভারে ট্যানারি স্থনান্তর করা হলেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণে জটিলতায় দূষণের শিকার হয় ধলেশ্বরি নদীর পানি। এ নিয়ে পরিবেশ আন্দোলনের নেতা কথা বললেও তেমন কাজ হয়নি।
চাহিদা অনুযায়ী চামড়া শিল্পকে আধুনিকায়ন না করলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সমস্যা সমাধানে মালিক ও সরকার- দু'পক্ষকেই সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
মূলধনের ঘাটতি কমাতে সাভারে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণে ঋণের ৬৩৯ কোটি টাকা মওকুফ করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা।
খাত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ দেশী-বিদেশী নানামুখী ষড়যন্ত্রে শিকার চামড়া শিল্প। আর এ ষড়যন্ত্রকারিদের মদদে প্রভাবশালী সংঘবদ্ধ চক্রের কারণে চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের চামড়ার ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে,আর্ন্তজাতিক ষড়যন্ত্রের কাছে হেরেই পাট শিল্পের ঐতিহ্য হারায় বাংলাদেশ। লোকসানের মুখে একে একে সব সরকারি পাট কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বৈদেশিক মুদ্রা হারায় বাংলাদেশ। এখনও এই প্রতিকূল পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ।
এখন আবার নতুন করে বিদেশিদে হাতে তুলে দিতে চামড়া শিল্প নিয়ে এই চক্র মেতে উঠেছে। তারই অংশ হিসেবে তারা গত কয়েক বছর ধরে চামড়া শিল্পে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। গত পাঁচ বছরেই চামড়ার দাম কমেছে অর্ধেক। অথচ চামড়া এবং চামড়াজাত সকল পণ্যেও দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। তাহলে দাম কমছে কেন।
ট্যানারি শিল্প প্রস্তুত বিসিকের এমন রিপোর্টেও ভিত্তি তখন আদালত রায় দিলো কারখানা স্থানান্তর না হলে প্রতি দিন ১ লাখ টাকা জরিমান দিতে হবে। বাধ্য হয়ে তারা সাভারে কারখানা স্থনান্তর করলো। কিন্তু সেখানে তারা এখনও কারখানা চালু করতে পারেনি। আর কারখানা স্থনান্তরের আজুহাতে গত কয়েক বছর ধরে তারা চামড়া কিনতে পারছে না। এতে করে চামড়ার দাম কমে যাচ্ছে। প্রতিবেশি দেশে চামড়া পাচার হয়ে যাচ্ছে।

পোস্তার কাঁচা চামড়ার আড়তদার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড এন্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, চামড়া নিয়ে ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। সরকার বাস্তব অবস্থা না দেখে বিসিকের রিপোর্ট দেখেই আমাদের সাভারে স্থনান্তর করে দিলো।
কোন কারন ছাড়াই আমাদের সকল সংযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিলো। এতে করে বাধ্য হয়ে সাভারে কারখানা স্থনান্তর করে ট্যানারি মালিকরা। এ সংকট মালিকরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
বাংলাদেশ হাইড এন্ড স্কিন মার্চেন্ট এসোসিয়েশন সভাপতি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, টাকার অভাবে এবার চামড়ার বাজারে এমন ধস নেমেছে। কয়েক বছর ধরে ট্যানারি মালিকরা আড়তদারদের তিন থেকে সাড়ে তিন শ কোটি টাকা আটকে ফেলেছে।
সিন্ডিকেট করার অভিযোগ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, চামড়া শিল্পের সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। সাভারে কারখানা স্থনান্তর। ব্যাংক ঋণ না পাওয়া। রফতানি অর্ডার চলে যাওয়া। একই সাথে এখানে রয়েছে দক্ষ শ্রমিকের সংকট। সব মিলে নানা সংকটে দিন কাটছে ট্যানারি শিল্পের। এ সংকট কাটিয়ে না উঠতে পারলে এ শিল্প হয়তো একদিন পাট শিল্পের মত আমাদের হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে।

সারা বিশ্বে বাংলাদেশের চামড়া এবং চামড়া জাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ চাহিদা অনুযায়ী যদি আমরা চামড়া জাত পন্য রফতানি করতে পারি তাহলে অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে। এজন্য এখাতকে বাচাতে হলে সরকারকে নগদ প্রনোদনা দিতে হবে।
শাহিন বলেন, চামড়া শিল্পে ক্রান্তিকাল চলছে। বেশিরভাগ ট্যানারি উৎপাদনে নেই। গত বছরের ৪০-৪৫ শতাংশ চামড়া এখনও অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। চামড়া শিল্পের এমন দশার নেপথ্যে রয়েছে সরকারি সহায়তা না থাকা আর পুঁজি সংকট।
বিটিএ সভাপতি আরও বলেন, সাভারে পরিকল্পিত ট্যানারি শিল্প গড়ে না উঠার দায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক)। ভুল তথ্য দিয়ে ট্যানারি মালিকদের সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছিলো। বার বার সময় বাড়িয়েও এ পরিকল্পিত শিল্প নগরীর কাজ শেষ না হওয়ার দায় বিসিকের। আগামী বছরের জুনেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের কাজ শেষ হবে না বলে শঙ্কা ট্যানারি এসোসিয়েশনের।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড এক্সপোর্টার এসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের প্রধান ক্রেতাদের অন্যতম চীন। এবারে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আরোপ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। চীন কম দামে পণ্য কেনার আলটিমেটাম দিয়েছে। তাই কোনোভাবেই নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কাঁচা চামড়া কেনা সম্ভব নয়। এ ছাড়া নতুন ট্যানারি নির্মাণ করায় পুঁজির সংকটে আছে ট্যানারি মালিকরা। এবারে ৪২টি ট্যানারি কাঁচা চামড়া কিনতে ৬০১ কোটি টাকা ব্যাংকঋণ পেয়েছে। বাকিরা কী করবে?
বসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কাঁচা চামড়া কমে কিনতে চেষ্টা করে। অর্থসংকট থাকে তাদের বড় ইস্যু। অথচ সরকার প্রতিবছর ব্যবসায়ীদের গড়ে ৫০০ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ দেয়। সাভারে কারখানা নির্মাণেও আর্থিক সহযোগিতা করেছে। তাই অজুহাতগুলো সম্পূর্ণ সঠিক নয়। শিল্প খাতের এ বিশ্লেষক বলেন, কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রিতে একটি চেন আছে। ট্যানারির মালিকরা দাম কম দিলে অন্যরাও কম দিতে বাধ্য হয়। তবে ট্যানারি মালিকরা বিশ্ববাজারে ভালো দামে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করলেও আড়তদার, চামড়া সংগ্রহকারীদের সে সুযোগ থাকে না।

http://www.dailysangram.com/post/349095