১৩ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ১০:২৫

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা শুভবুদ্ধির পরিচায়ক নয়

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী
গতবছর সাউথ এশিয়ান মনিটর রিপোর্ট করে: বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা উদযাপিত হয় ধুমধামের সঙ্গে। কিন্তু গতবারের পূজা আসামের গৌহাটিকে করেছিল খবরের শিরোনাম। দেবী দুর্গার ১০০ ফুট উঁচু প্রতিমা তৈরি করা হয় ভারতের এ শহরে। তাও আবার বাঁশ দিয়ে। আর এর নকশাকার ছিলেন এক মুসলিম শিল্পী। নাম নুরুদ্দিন আহমদ। বাঁশ দিয়ে তৈরি বিশ্বের সবচেয়ে বড় কাঠামো হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে এ কর্ম স্থান পাবার আশা ছিল শিল্পী নুরুদ্দিন ও আয়োজকদের। পেয়েছে কিনা জানা যায়নি। তবে তিনি যে কর্মটি করেছেন তা ভারতীয়দের অনেকেই লুফে নিয়েছেন সঙ্গত কারণে। এর প্রভাব পড়েছে এবার ভারতের কোনও কোনও ম-পে। জি বাংলা টিভি চ্যানেলের প্রচারণায় তা দেখ গেছে। এতে দেখা যায় অসুরকে গতবছর গৌহাটিতে নুরুদ্দিন যেভাবে সাজিয়েছিলেন ঠিক সে আদলে।

উল্লেখ্য, দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে অনিবার্যভাবে আরও যেসব মুর্তি থাকে সেগুলোর একটি হচ্ছে অসুর বা মহিষাসুর। এ সেই দুষ্টু দৈত্য দুর্গা যাকে যুদ্ধে শেষপর্যন্ত বিনাশ করেন। গৌহাটির কাঠামোতেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। কিন্তু এতে অসুরকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তা ছিল খুবই ষড়যন্ত্র ও উসকানিমূলক। শুধু তাই নয়। অনেকের জন্য তা নিতান্ত বেদনাদায়কও।
সাধারণভাবে অসুরকে উপস্থাপন করা হয় গোঁফধারী, কালো গাত্রবর্ণ, রাগান্বিত ও ক্ষুব্ধ চক্ষুবিশিষ্ট একজন যুদ্ধংদেহীরূপে। যার এক হাতে খোলা তরবারি, আরেক হাতে স্বর্পভঙ্গিতে দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধপ্রস্তুতি। অসুরের এই ভাবমূর্তির অন্যথা আগে চোখে পড়েনি বললেই চলে। কিন্তু বিষ্ণুপুর সর্বজনীন পূজা কিমিটির ওই সুদীর্ঘ দুর্গাপ্রতিমার সঙ্গে এক ভিন্ন চেহারার অসুরকে দেখা যায় গতবছর। দুর্গার পায়ের তলায় আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে পড়ে থাকা বাঁশের তৈরি এ দুষ্টু দৈত্যকে দেখে স্পষ্টতই মনে হয় যেন কোনও এক নিষ্ঠাবান মুসলিম। মুখভর্তি দাড়ি। মাথায় টুপি। পরাজয়ের ভঙ্গিতে যেভাবে পড়ে আছে, তাতে একজন পরাজিত দীনদার আলেমের অপমানজনক অনুভুতি টের পাওয়া যায়। তাই হতভম্ব দর্শকদের প্রশ্ন, মহিষাসুর টুপি পরতে শেখলো কবে, দাড়িইবা তার ছিল কখন?
বলা বাহুল্য, গরুর গোশতভক্ষণের জন্য মুসলিমদের ওপর হামলাই হোক অথবা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের নির্মমতা থেকে বাঁচতে আশ্রয়ার্থী অসহায় রোহিঙ্গাদের শাস্তি প্রদানই হোক এ সন্ধিক্ষণে ভারতে নিয়মিত বিরতিতে মুসলিমবিরোধী চেতনার বিক্ষিপ্ত বিস্ফোরণ ঘটে, তখন এ দৈত্যকে মুসলিমরূপ প্রদানের সুস্পষ্ট তাৎপর্য রয়েছে বলেই মনে হয়। আর সেই কাজটিও করানো হয়েছে একজন মুসলিমশিল্পীকে দিয়ে। তাই মুসলিমদের খোঁচাতে ইচ্ছাকৃতভাবে এটা করা হয়েছে কিনা সে প্রশ্ন পর্যবেক্ষক মহলের। তাদের জিজ্ঞাসা, কট্টর হিন্দুত্ববাদে প্রভাবিত বিজেপি সরকারের আমলে এটা কি কোনও ‘পরীক্ষামূলক’ ঘটনা?
মুসলিমদের আর কতভাবে অপদস্থ করা যায়, তারা কি এর শেষসীমা দেখতে চান?
উল্লেখিত কাঠামো গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে অন্তর্ভুক্ত হলে তা অসুরের একটি প্রতিষ্ঠিত প্রতিমূর্তি হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। এ নতুন ‘মুসলিম’ ধাঁচের অসুর মূর্তিই কি হবে তাহলে মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানোর মোক্ষম আদর্শ? দৈত্যরূপে চিত্রায়িত করে বিশ্বব্যাপী মুসলিমচেহারায় কালিমা লেপনের এটা কি কোনও চতুর ষড়যন্ত্র?

ইতোমধ্যে আসামের নাগরিকপঞ্জি থেকে অনেক মুসলিমসহ বাংলাভাষীদের বাদ দেয়া হয়েছে। চিনের উইঘুর মুসলিমদের মতো নাগরিকপঞ্জির বাইরে থাকা বিশেষত মুসলিমদের বন্দিশিবিরে নিয়ে নির্যাতন চালাবার অভিযোগ উঠেছে। ক্ষমতাসীন দল বিজেপির নেতারা বাংলাভাষীদের ভারত থেকে তাড়িয়ে দেবার হুঙ্কার ছাড়ছেন বাংলাসহ সারাদেশে হররোজ। উর্দুভাষীরা পাকিস্তানি আর বাংলাভাষীরা বাংলাদেশি। এমন মানসিকতাই প্রকাশ্য হয়ে উঠছে বিজেপি নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে। অথচ ২০ কোটিরও বেশি বাংলাভাষী মানুষ বাংলা, আসাম, ত্রিপুরাসহ দেশটির সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন। বিহার ও উড়িষ্যাতেও অনেক বাংলাভাষী রয়েছেন যারা জন্মসূত্রে ভারতীয়। আমি নিজে দিল্লি, লক্ষেèৗ, নাগপুর, জৌনপুর, ভুপালে কোনও কোনও বাংলাভাষীর সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা সবাই বংশানুক্রমে ভারতীয় নাগরিক। তবে জৌনপুরে বরিশালের এক বাংলাভাষী রিকশাওয়ালার দেখা পেয়েছিলাম। লোকটি রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে উত্তর প্রদেশের এ শহরে গিয়ে ওঠেন এবং ওখানে উর্দুভাষী এক রমণীর সঙ্গে বাঁধা পড়েন। বৈবাহিক সূত্রে তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবার কথা।
বেআইনিভাবে স্বল্প সংখ্যক বাংলাভাষী সীমান্তরক্ষীদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভারতের কোথাও গিয়ে থাকতেই পারেন। আবার ভারতীয়রাও একইভাবে এদেশে এসে থেকে যেতে পারেন। এমন অভিযোগ এদেশ থেকেও উঠেছে। তাই প্রমাণ সাপেক্ষে উভয় দেশে কোনও অনুপ্রবেশকারী বেআইনিভাবে অবস্থান করলে তাদের আইনানুগ বিনিময় হতেই পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে ভারতের বাংলাভাষীদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবার লক্ষ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতাদের প্রকাশ্যে বারবার ঘোষণা কেবল উদ্বেগজনকই নয়, তা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের প্রতি হুমকিও। তাই আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।

ভারত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ। বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ছোট হলেও স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধেও ভারতের অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশ কখনই চায় না দুই দেশের সম্প্রীতির বন্ধন কখনও নষ্ট হোক। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ থেকে যেন ইচ্ছে করেই বন্ধুত্ব-সম্প্রতি বিনষ্টের আচরণ করা হচ্ছে। গতবছর গৌহাটিতে দুর্গাপ্রতিমার অসুরমূর্তিতে দাড়িটুপির সংযোজন এমনই একটি আপত্তিকর আচরণ। এবার সেখানে কী হচ্ছে আমরা এখনও জানি না। তবে বাংলাভাষীদের সঙ্গে যে বৈরি এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে তা আর বলবার অপেক্ষা রাখে না। ইতোমধ্যে আসামের ৪০ লাখ বাংলাভাষীকে নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ রেখে তাদের অনেককে বন্দিশিবিরে আটকে রাখা এবং সারাভারতের বাংলাভাষী নাগরিকদের বাংলাদেশে ঠেলে দেবার জন্য ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতাদের প্রকাশ্য হুমকি-ধমকি এবং অসুরের মুখে দাড়ি ও মাথায় টুপির সংযোজনের নিবিড় সম্পর্ক থাকতে পারে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি। এতে মুসলিমদের অসুর বা দানব হিসেবে চিত্রিত করে ধর্মীয় প্রতিহিংসা ছড়িয়ে দেবার ভয়ানক ষড়যন্ত্র কাজ করছে। তাই এ ব্যাপারে ভারতীয় সকল সচেতন ও আধুনিক মনস্ক নাগরিককে ভাবতে হবে। বিবেচনা করতে হবে। মানুষের মাঝে বিদ্বেষ আর প্রতিহিংসা যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। সাম্প্রদায়িক বন্ধুত্ব-সম্প্রীতি যাতে কোনওভাবেই বিনষ্ট না হয়। এতে দেশ, জাতি বা কোনও সম্প্রদায়ের মঙ্গল হয় না। বরং অমঙ্গলই ঘটে বেশি। উল্লেখ্য, ভারতের মতো আমাদের এদেশেও শারদীয় পূজানুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। এনিয়ে এখানে কোনওরকম সাম্প্রদায়িক উসকানি বা বিরোধ নেই। এসত্ত্বেও দুই-এক স্থান থেকে প্রতিমা ভাঙচুরের দুঃসংবাদ পাওয়া গেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা এবং জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের হাতে তুলে দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের জোর দাবি জানাচ্ছি।

আরেকটা কথা না বললেই নয়, সেটা হচ্ছে: দাড়ি কেবল মুসলিমরাই রাখেন না। অনেক হিন্দুও রাখেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লম্বা দাড়ির কথা কি ভুলে গেছেন কেউ? সাবেক সন্ন্যাসী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদিজীর মুখেও সামান্য হলেও দাড়ি দেখছি আমরা। অন্য সন্ন্যাসীদেরতো চুলদাড়ি সব আস্তই থাকে। আর টুপিও শুধু মুসলিমরাই পরেন না। ভারতের অনেক অমুসলিম নেতাও টুপি পরিধান করেন

http://www.dailysangram.com/post/349114