১২ অক্টোবর ২০১৮, শুক্রবার, ৮:৩৫

ব্যাংকিং খাতে অরাজকতা

মোহাম্মদ জাহিদ

ইতঃপূর্বে যাদের ঋণখেলাপি করা হয়েছে, এখন সেই খেলাপি ঋণকলঙ্ক থেকে দলীয় লোকদের বাঁচাতে আশ্রয় নেয়া হয়েছে অভিনব কৌশলের। এ জন্য খেলাপির তালিকায় নাম না ওঠাতে আদালতে মামলা দিয়ে তা চালু রাখা হয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি না করতে বিভিন্নভাবে তৈরি করা হয় দীর্ঘসূত্রতা। সম্প্রতি ঋণখেলাপি হওয়ার যত ঘটনা ঘটেছে, সবগুলোতে প্রভাবশালী উচ্চ মহলের হাত রয়েছে বলে মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকরা। এই ঋণখেলাপিদের বাঁচাতে ক্ষমতাসীনরা সব দায়দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে যেন তুলে নিয়েছেন। এভাবে অন্যায়ের বৈধতা দেয়ার কাজটি করতে তারা সব নীতিনৈতিকতা ভুলে যান। এ দিকে ব্যাংক মালিকদের অবৈধ আবদারও পূরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন কর্মকর্তারা। আর এসব কাজ দেখেও ব্যবস্থা নিতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। এর এখতিয়ার থাকলেও নীরব সাক্ষীর ভূমিকা পালন করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ দিকে সরকারের উচ্চ মহল এবং ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতারণার মাধ্যমে আবারো ঋণ পাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা।

বিশ্লেøষকরা বলছেন, সরকার নিজেদের লোকদের দুর্নীতির তকমা থেকে রেহাই দিতে সংসদের মতো জায়গাকেও ব্যবহার করছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ১০০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করেছেন। সেই তালিকাতে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে রাঘববোয়ালদের। তালিকায় চুনোপুঁটিদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। যারা সমাজে বড় বড় ঋণখেলাপি ও ব্যাংক জালিয়াত হিসেবে পরিচিত, তাদের নাম অবশ্যই থাকা চাই। রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে আইনের ফাঁক গলিয়ে তারা পার পেয়ে গেছেন। এটা জনগণের সাথে একধরনের প্রতারণা বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে দুর্নীতির দুর্বৃত্তায়ন মহামারীর রূপ নেবে। এ অবস্থায় শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, দেশের সার্বিক অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত দেশে ঋণখেলাপি দুই লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ জন। তাদের কাছে অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ এক লাখ ৩১ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রীর তালিকায় থাকা ১০০ জনের পাশাপাশি খেলাপি ঋণের সাথে জড়িত ৮৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামও প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকে ১৮ হাজার ৬৬২ কোটি, জনতা ব্যাংকে ১৪ হাজার ৮৪০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ৯ হাজার ২৮৪ কোটি, রূপালী ব্যাংকে চার হাজার ৯০১ কোটি, বেসিক ব্যাংকে আট হাজার ৫৭৬ কোটি, কৃষি ব্যাংকে দুই হাজার ১৭৮ কোটি, বাংলাদেশ ডেভেলমেন্ট ব্যাংকে দুই হাজার ৩৩২ কোটি, পূবালী ব্যাংকে দুই হাজার ১১৬ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকে পাঁচ হাজার ৭৬ কোটি, ইসলামী বাংকে তিন হাজার ৫২০ কোটি আর প্রাইম ব্যাংকে তিন হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা খেলাপি রয়েছে। সূত্র জানায়, এর বাইরে আরো অনেক খেলাপি ঋণ রয়েছে। অনেকে ঋণখেলাপি হলেও সেগুলো তারা বাংলাদেশ ব্যাংকে খেলাপি হিসাবে দেখান না। দুর্নাম এড়াতে তারা খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখান। এতে বিশেষ করে প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতারা খেলাপি তালিকার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে এ রকম অনেক প্রতিষ্ঠানের ঋণকে খেলাপি করা হয়েছে। প্রতি বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে টাকার অঙ্কে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি চিহ্নিত করার নির্দেশ দেয়া হয়। ক্রিসেন্ট গ্রুপের প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ জনতা ব্যাংক প্রথমে খেলাপি করেনি। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে খেলাপি করা হয়। কিন্তু ওই তালিকায় তাদের সব প্রতিষ্ঠানের নাম আসেনি। এসেছে মাত্র দু’টি প্রতিষ্ঠানের নাম। অ্যানন ট্যাক্স গ্রুপের পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু জনতা ব্যাংক এখনো তা করেনি। হলমার্ক গ্রুপ এখন সবচেয়ে বড় খেলাপি। তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ চার হাজার কোটি টাকা। কিন্তু গ্রুপের একটি মাত্র প্রতিষ্ঠান এর তালিকায় এসেছে। এটি হচ্ছে হলমার্ক ফ্যাশনস; বাকিগুলো আসেনি।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যেসব বড় ঋণখেলাপির নাম প্রকাশ করা হয়নি, তাতে যত না আইনি জটিলতা তার থেকে রাজনৈতিক সমস্যা বেশি। তবু যাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছে, এটা প্রাথমিক উদ্যোগ। যারা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত তাদের যেন আর নতুন ঋণ দেয়া না হয়। এ ছাড়া এসব খেলাপিকে সব ধরনের নীতি-সহায়তা থেকে বঞ্চিত করতে হবে। তা না হলে শুধু নাম প্রকাশ করে কোনো লাভ হবে না।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, শুধু নাম প্রকাশ করা যথেষ্ট নয়। তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ব্যাংকিং খাতে খেলাপিসহ বিভিন্ন কুকর্মে যারা জড়িত, তাদের সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। বরং কখনো কখনো সুরক্ষা দিয়েছে। ‘সুজন’ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘ব্যাংক থেকে টাকা মেরে ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি দেশে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির খবর প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্বের মধ্যে ধনী হওয়ার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। মূলত বিচারহীনতার কারণে ব্যাংকিং খাতে একধরনের অরাজকতা বিরাজ করছে। আমরা এই খাতে লুটপাটের অবসান চাই।’হ

http://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/356264