১১ অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৫:৩৭

ব্যবসায় মন্দা : পুঁজি ভেঙে খাচ্ছেন অনেকে

রাজধানীর খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের ব্যবসায়ী সোলায়মান। ক্রোকারিজ মালামালের ব্যবসায় করেন তিনি। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, কয়েক মাস থেকে ব্যবসায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। বেচাবিক্রি নেই বললেই চলে। সামনে বাচ্চাদের পরীক্ষা। পরীক্ষার ফি, ভর্তি, বইপত্র কেনাসহ সম্ভাব্য খরচ কোত্থেকে জোগাড় করবেন তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার কথা জানালেন তিনি। ব্যবসায় মন্দার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, গত রোজার ঈদের আগে থেকে যা বিক্রি হয় তাতে দোকান খরচই আসে না। বাসাভাড়া, বাজার খরচ, চিকিৎসা ব্যয় এবং বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ চলছে দোকানের পুঁজি ভেঙে।
সোলায়মান জানান, তার একার নয়, মার্কেটের সবার ব্যবসায়ই মন্দাবস্থা চলছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে ব্যর্থ হয়ে গত কয়েক বছরে অর্ধেকের বেশি দোকানদার ব্যবসায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। যাদের দোকান নিজস্ব তারা ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। মাস শেষে ভাড়া তুলে খাচ্ছেন। তাতেও ভালো, লোকসান কম হচ্ছে। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, এসব দোকান নতুন করে ভাড়া নিচ্ছেন কারা? জবাবে সোলায়মান বলেন, মানুষের হাতে তো কাজ নেই। ধরেন একজন লোক বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন। হাতে কিছু টাকা আছে। ওই টাকা দিয়ে অনেক বড় আশায় একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসায় শুরু করেছেন। কিছু দিন পর টের পেলেন, ব্যবসাবাণিজ্য নেই। দিন দিন পুঁজি কমে যাচ্ছে। এভাবে একদিন পুঁজি হারিয়ে তিনিও দোকান বন্ধ করে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সোলায়মানের কথার সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গেলে বেরিয়ে আসে ব্যবসায়ীদের হাহাকারের চিত্র। ঢাকার মার্কেটগুলোয় কয়েক লাখ খুচরা দোকান থাকলেও লাভে আছে খুব সামান্যই। অধিকাংশ মার্কেটে বেচাকেনা নেই বললেই চলে। বিশেষ করে পোশাকের দোকানগুলো রোজার মাস ছাড়া বাকি ১১ মাসই লোকসানে থাকে। মালিকরা এ সময় দোকানভাড়া, কর্মচারী বেতন এবং বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতেই হিমশিম খান। পাড়া মহল্লার চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের দোকানগুলো সারা বছর চললেও তৈজসপত্র, প্রসাধনী এবং পারিবারিক ব্যবহার্য পণ্যসামগ্রীর দোকানিরা রয়েছেন সবচেয়ে বেশি চাপে।

আলাপ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো: হেলাল উদ্দিন গতকাল মঙ্গলবার নয়া দিগন্তকে বলেন, সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই। টাকা চলে গেছে অল্প কিছু মানুষের হাতে। তারা কেনাকাটা করেন বিলাসবহুল মার্কেটে কিংবা বিদেশে। ফলে সাধারণ মানের মার্কেটগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। অন্য দিকে ঢাকার মার্কেটগুলোয় দোকানভাড়া অনেক বেশি। বিদ্যুৎ বিল বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছে। সার্ভিস চার্জসহ অন্যান্য খরচও বাড়তি। এসব কারণে অধিকাংশ দোকানদার লোকসান দিয়ে পেশা টিকিয়ে রেখেছেন। অন্য কিছু করার সুযোগ নেই বলে দোকানদারি করছেন। কর্মসংস্থান না থাকায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন লোক ব্যবসায় আসছেন এবং লোকসান দিয়ে ব্যবসায় গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

অর্থনীতির এই দুরবস্থার চিত্র উঠে আসে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের মাধ্যমেও। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আবারো সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) হ্রাস পেয়েছে। এ সময়ে আমদানি রেকর্ড পরিমাণে বাড়লেও সেই তুলনায় বিদেশী বিনিয়োগের হার নগণ্য। আলোচ্য অর্থবছরে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে ২৭৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ কম। অন্য দিকে শেয়ারবাজারেও বিদেশী বিনিয়োগ কমেছে। অর্থবছর শেষে শেয়ারবাজারে ৩৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ এসেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (বিওপি) অনুযায়ী সেই অর্থবছরের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে বিদেশী ঋণ গ্রহণের পরিমাণও বেড়েছে। আলোচ্য সময়ের আর্থিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের ঋণ এসেছে ৫৭৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা আগের একই সময়ের তুলনায় ৭৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি। বিদেশী ঋণ বাড়লেও বিদেশী বিনিয়োগ কমে এসেছে।

এ দিকে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের বর্তমান স্থবিরতা দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণ। সংস্থাটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্রমবর্ধমান ঋণের স্থিতি ও ঋণ পরিশোধে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি দেশের উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিনিয়োগ হ্রাস এবং আন্তঃপ্রজন্ম ঋণের বোঝা বৃদ্ধি করছে। অভ্যন্তরীণ উৎস বিশেষ করে ব্যাপক হারে জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিক্রির (চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ৩৯ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ০৮ শতাংশ বেশি) মাধ্যমে সরকারের বাজেট ঘাটতি অর্থায়ন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের চাহিদা হ্রাস নির্দেশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় যথাক্রমে ১৫ দশমিক ১২ ও ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। এ দিকে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের স্থিতি পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৩২ শতাংশ বেড়েছে। অন্য দিকে নিট বৈদেশিক সাহায্যের প্রবৃদ্ধি ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ১৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে।


http://www.dailynayadiganta.com/last-page/356080