চকরিয়ার বদরখালীতে চাহিদার চোয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হওয়ায় উৎফুল্লচিত্তে লবণ চাষি ও বিলিকিস সল্টস্ লিঃর স্বাত্ত্বাধিকারী হোসাইন কাইফু
১১ অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৫:৩৬

ভিত্তিহীন সংকটের অজুহাতে অসাধু সিন্ডিকেট কর্তৃক ফের লবণ আমদানির পাঁয়তারা

ভিত্তিহীন সংকটের অজুহাতে এবার ভারতভিত্তিক এক শ্রেণির অসাধু মিল মালিক সিন্ডিকেট লবণ আমদানির পাঁয়তারা চালাচ্ছেন। পর্যাপ্ত লবণ মজুদ থাকার পরও চাষিদের কষ্টার্জিত চাহিদা অতিরিক্ত উৎপাদিত মজুদকৃত লবণের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখাচ্ছেন তারা। এমনকি নভেম্বরে পুরোদমে লবণ উৎপাদন মওসুমও মানছে না ওই সিন্ডিকেট। খামকায় আনতে হবে এ ধরণের অযৌক্তিক যুক্তি দেখিয়ে বিদেশ থেকে সিন্ডিকেটটি লবণ আমদানির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ভারতনির্ভর লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র দীর্ঘদিনের। সুযোগ পেলেই বিদেশ থেকে লবণ আনতে উঠে পড়ে নামে মুনাফালোভি চক্রটি।

অথচ গত ২৫সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে বিসিকের এক কর্মশালায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছেন ‘এই মুহূর্তে লবণের সংকট নেই, আমদানি করা হবেনা’। অবশ্য শিল্পমন্ত্রী আশ্বস্থ করেন- লবণ চাষি, মিল মালিক ও বিসিকের সমন্বয়ে মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি বলেন, লবণ চাষি, লবণ মালিক, বিসিকের প্রতিনিধি, মিল মালিক, এদেরকে নিয়ে মনিটরিং করা হবে। মনিটরিং করে যেটা সঠিক মনে হবে- সেভাবেই আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
অভিযোগ এসেছে, নিজেদের পকেট ভারী করতে আমদানিকারক একটি সিন্ডিকেট জোরেশোরে সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। ওই সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন গত কয়েকদিন ধরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে বহুমুখি তদবির চালাচ্ছে। এতে দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির রাস্তা সহজ করতে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে দপ্তরগুলোতে।
বিসিক বলছে, দেশে ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিকটন লবণ মজুদ আছে। লবণ চাষিদের দাবি, ৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি লবণ অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে মাঠে। বর্তমানে লবণের কোনও ধরণের সংকট নেই। অধিকাংশ মিল মালিকও লবণ আমদানির বিপক্ষে।
এদিকে লবণের চাহিদা মজুদ নিরূপণের লক্ষ্যে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে বিসিক। গেলো ২৬সেপ্টেম্বর মহাব্যবস্থাপক মো. মাজহারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান আহবায়ক ও বিসিক কক্সবাজারের লবণশিল্পের উন্নয়ন কর্মসূচির উপ-মহাব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরীকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
কমিটির সদস্যরা হলেন- লবণ চাষি কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কায়ছার ইদ্রিস, কক্সবাজার লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি রইছ উদ্দিন ও ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি মো. শামসুল আলম আজাদ। এদের মধ্যে একজনই আমদানির পক্ষে বলে জানিয়েছে লবণ মিল মালিক ও চাষিরা।

সূত্রমতে, কক্সবাজার, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলা (আংশিক)সহ ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমি রয়েছে। চাষি রয়েছে ৫৫ হাজারের বেশি। এসব চাষি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লবণ উৎপাদন করে। কিন্তু দালাল, ফঁড়িয়া ও আমাদনির চক্রের দৌরাত্ম্যে বারবার ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হচ্ছে চাষিরা। মাঠ পর্যায়ে চাষিদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে লবণ কিনে অধিক মুনাফা অর্জন করছে মধ্যস্বত্বভোগী ও মিল মালিকরা। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও অসাধু চক্রটি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে বসে এনে লবণ আমদানি করে ওই চক্র। আর এসব আমদানির পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মদদ যোগাচ্ছে অসাধু মিল মালিক সিন্ডিকেট। অথচ আগামী নবেম্বর থেকে পুরোদমে শুরু হচ্ছে লবণ মওসুম।

মহেশখালী, চকরিয়া, ইসলামপুর, টেকনাফ, পেকুয়ার অন্তত ১০টি এলাকায় খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, এখানে প্রচুর পরিমাণ লবণ মজুদ আছে। উৎপাদনমূল্য না পাওয়ায় চাষিরা লবণ বিক্রি করছেনা। চাষিরা জানায়, যে লবণ গত এক মাস আগে বস্তাপ্রতি ৭৮০ টাকায় বিক্রি হতো সে লবণ বর্তমানে ৭০০ থেকে ৭২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি হওয়ায় পূর্বের তুলনায় লবণের দাম নিম্নমুখি। বাজারে লবণের সরবরাহ ঠিক আছে। কোথাও ঘাটতি নেই বললেই চলে।
ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি মো. শামসুল আলম আজাদ বলেন, ফঁড়িয়ারা ছাড়া অধিকাংশ মিল ও মাঠে প্রচুর লবণ মজুদ আছে। বিসিকের রিপোর্ট মতে, ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন লবণ জমা আছে। ঘাটতির কোন অশংকা নেই। এরপরও লবণ শিল্পের ক্ষতি হয়; এমন কোন আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবেনা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে দেশে লবণের চাহিদা ছিল ১৫ দশমিক ৭৬ লাখ মেট্রিকটন। এই মওসুমে উৎপাদন হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৪ লাখ মেট্রিকটন। এ হিসাবে চাহিদার তুলনায় লবণের ঘাটতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার মেট্রিকটন। সেই বছর ৫ লাখ মেট্রিকটন আমদানি বাদে ২ লাখ ৮৮ মেট্রিকটন উদ্বৃত্ত থাকে।

২০১৮ সালে ১৬ লাখ ২১ হাজার মেট্রিকটন লবণ চাহিদা ছিল। এই বছর ১৪ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিকটন লবণ উৎপাদন হয়। ঘাটতি থাকে ১ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিকটন। ২০১৭ সালের উদ্বৃত্ত ২ লাখ ৮৮ মেট্রিকটন বাদে বর্তমানে ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিকটন লবণ চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত রয়েছে।
ইসলামপুরের লবণ চাষি ফরিদুল আলম বলেন, দেশে চাহিদা অনুযায়ী প্রচুর পরিমাণ লবণ উৎপাদন হওয়ার পরও তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে লবণ আমদানি করতে চাচ্ছে। মাঠে প্রচুর অবিক্রিত লবণ পড়ে আছে। যা মওসুম শুরু হয়েও বাঁচবে।
লবণের চাহিদা মজুদ নিরূপণে গঠিত ৫ সদস্যের কমিটির আহবায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান বলেন, মিল ও মাঠের তথ্য যাচাই করে প্রতিবেদন দিতে বিসিককে বলা হয়েছে। সেই প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে, দেশের ক্ষতি হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবেনা।
বিসিক কক্সবাজারের লবণশিল্পের উন্নয়ন কর্মসূচির উপ-মহাব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরী বলেন, মিল ও মাঠের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। শীঘ্রই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।

http://www.dailysangram.com/post/348851