১১ অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৫:৩২

রহস্যময় এক রাজনীতির নাম সন্ত্রাস

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর প্রকাশ্যে যে নির্মম হামলা চালানো হয়েছিল তা ভোলার নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, হামলাকারীদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আইনের আওতায় আনা হয়নি। ৪ অক্টোবর তারিখে প্রথম আলোয় মুদ্রিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংবাদিকদের চাপের মুখে প্রতিকারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন তথ্যমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশকে। ঘটনার পর দুই মাস গত হতে চললো কিন্তু কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। উল্লেখ্য যে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় গত ৫ আগস্ট রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় হামলা করেন ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ওই হামলায় ১২ জন কর্তব্যরত সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। এই হামলার ভিডিও এবং স্থিরচিত্র গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কিন্তু মাথায় হেলমেট পরা লাঠিধারী হামলাকারীরা এখনও গ্রেফতার হয়নি।

প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা যায় যে, হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের হস্তক্ষেপ চেয়ে গত ৭ আগস্ট চিঠি দিয়েছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ওই চিঠির পর কী হলো, জানতে চেয়ে চলতি সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক ও পুলিশ শাখায় যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু এই দুই শাখার কর্মকর্তারা এ ধরনের কোন চিঠি হাতে পাননি বলে প্রথম আলোকে জানান। আর তথ্যমন্ত্রীর চিঠির পর পুলিশের পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘তথ্যমন্ত্রী চিঠি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। তাই এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভালো বলতে পারবেন, আমার জানা নেই।’ এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছিলাম। কেন পুলিশ এখনও মামলা করেনি তা পুলিশ কমিশনারের কাছে জানতে হবে। তবে আমি আবারও আশ্বস্ত করতে চাই, হামলাকারীদের চিহ্নিত করে আমরা ব্যবস্থা নেব, সাংবাদিক নেতাদের কাছে দেয়া কথা আমরা রাখবো।’ আর চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছেন কিনা, জানতে চাইলে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘আমাদের তো আশ্বস্ত করা হয়েছিল তারা ব্যবস্থা নেবে, কিন্তু নিলো না। সাংবাদিকদের ওপর এভাবে হামলা করার পরও যদি বিচার না হয় তবে সাধারণ মানুষের কী হবে?’ তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবারও যোগাযোগ করবেন বলে জানান।

সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ কমিশনার, তথ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য ভেবে দেখার মতো। তাদের বক্তব্য আমাদের আশাবাদী করে না বরং এই উপলব্ধি দেয় যে, আইন তার নিজের গতিতে চলছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলার পরও আইন তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারছে না কেন? রহস্য কোথায়? বিরোধী দলের লোকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের ক্ষেত্রে তো পুলিশ বেশ তৎপর ও চৌকস মনে হয়। কিন্তু সরকারি দলের লোকদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশ এতো অসহায় ও দুর্বল হয়ে পড়ে কেন? সরকারের আচরণে যদি অনুরাগ ও বিরাগের বিষয়টি প্রবল হয়ে ওঠে তাহলে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে কেমন করে? আর সাংবাদিকদের সাথে যে আচরণ করা হলো তাতে তো সন্ত্রাস প্রশ্রয় পাবে।

সন্ত্রাস ও উগ্রতার বিরুদ্ধে অনেকেই কথা বলেন। আমরা জানি জনমত উগ্রতার বিরুদ্ধে। তাই এ বিষয়ে কথা বলা বেশ সহজ ও নিরাপদ। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, সন্ত্রাস-উগ্রতার বিরুদ্ধে সঠিক কথা ক’জনা বলেন? উৎপত্তির কারণ ও যথাযথ বিশ্লেষণ কতটা হয়? অনেকের কথা শুনেতো মনে হয়, সন্ত্রাস ও উগ্রতার একটি নতুন বিষয় এবং তা একান্তভাবে ইিসলাম ও মুসলমানদের সাথে জড়িত। এমন প্রপাগান্ডায় উপলব্ধি করা যায়, বিষয়টির সাথে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং রাজনীতি জড়িয়ে গেছে। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ এবং তথ্য-উপাত্ত এখানে অনুপস্থিত। যে কোনো বিষয়ে যথাযথ বিশ্লেষণ ও সত্যানুসন্ধানে সততা ও ন্যায়ের চেতনার সাথে সাথে যে মানবজমিন থাকা প্রয়োজন, বর্তমান সভ্যতায় তা কতটা আছে? এখনতো শক্তিমানরা পরিকল্পনা করে অবৈধ রাজনৈতিক ও অস্ত্র ব্যবসার স্বার্থে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চাতুর্যের সাথে শান্তির মুখোশ পরে সন্ত্রাস ও গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন! তবে এ সবের রহস্য ও মুখোশ খসে পড়তে শুরু করেছে।

তুরস্কের ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র গত ২ অক্টোবর ইউরোপের উগ্র ডানপন্থী দলগুলোকে সন্ত্রাসী গ্রুপ ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা দায়েসের সাথে তুলনা করেছেন। দেশটির জাস্টিম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পর এক সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র ওমর সেলিক বলেন, ইউরোপের আইএস হচ্ছে সেখানকার উগ্র ডানপন্থী গ্রুপগুলো। তিনি বিশ্লেষণ করে আরো বলেন, ইউরোপের উগ্র ডানপন্থী দলগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম আইএসকে বিস্তারের সুযোগ দেয়। একই সময় আইএস সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম ওই দলগুলোকে আনুকূল্য দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের জন্য আইএস যেমন, ইউরোপীয়দের জন্য উগ্র ডানপন্থী দলগুলো সেরকমই।
সন্ত্রাস ও উগ্রতা প্রসঙ্গে ওই বক্তব্য অনেকের কাছে নতুন মনে হতে পারে। আসলে বাস্তবতা এমনই। সন্ত্রাস কোনো ধর্ম, দেশ বা জাতিগোষ্ঠীর একক বা নিজস্ব বিষয় হতে পারে না। যে কোনো দেশের বা ধর্মের ভ্রান্ত বা বিকৃত চিন্তার মানুষদের বিষয় হতে পারে সন্ত্রাস কিংবা উগ্রতা। কিন্তু এই বিষয়টি উপলব্ধির জন্য যে মানবিক সততা, ন্যায়বোধ ও জ্ঞান প্রয়োজন তা বর্তমান সভ্যতায় কতটা বিরাজ করছে।’ সবারই আত্মসমালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
বর্তমান সভ্যতায় ব্যক্তি, সম্প্রদায় এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বড় শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা। জুলুম-নির্যাতন, হত্যা-ধর্ষণের বীভৎস দৃশ্য সভ্যতার শাসকরা চেয়ে চেয়ে দেখেছেন। এখন মাঝে মাঝে কেউ কেউ উহ-আহ করছেন, কূটনীতির চাতুর্যময় ভাষায় কথা বলছেন ক্ষমতাবানরা। মজলুম রোহিঙ্গাদের পাশে কার্যকরভাবে কেউ দাঁড়াচ্ছেন না। আত্মসমালোচনা ও ন্যায়বোধের দুর্ভিক্ষ চলছে এখন পৃথিবীতে। তবে বর্তমান নিষ্ঠুর ও অমানবিক বিশ্বপরিবেশে বাংলাদেশের ভূমিকা ব্যতিক্রম। বাংলাদেশ আন্তরিকভাবেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশে দাঁড়িয়েছে। নির্যাতিত লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

মিয়ানমারের প্রতিবেশী বড় দেশ ভারত। কিন্তু সেখানে মিয়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গারা সেভাবে আশ্রয় পাচ্ছেন না। সম্প্রতি ভারত থেকে সাত রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ওদের বেঁচে থাকার ব্যাপারে শংকা প্রকাশ করে দিল্লীর এক শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ শান্তি না আসা পর্যন্ত দয়া করে আমাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাবেন না। আমরা অসহায়, আমাদের এখানে থাকতে দিন। ওরা আমাদের মেরে ফেলবে।’ হারুন নামে এক রোহিঙ্গা শরনার্থী বলেন, ‘আমরা ২০০৫ সাল থেকে ভারতে বাস করছি। কিন্তু সরকার ২০১৭ সাল থেকে ভিসা নবায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। মিয়ানমারে আজও আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে।’ উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি আসামের শিলচরের কাছাড় কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা সাত রোহিঙ্গা যুবককে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে ভারত। বেআইনিভাবে ভারতের ঢোকার দায়ে ২০১২ সালে তারা গ্রেফতার হয়েছিল। এখন তাদের হত্যা করা হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থায় নিবন্ধিত তথ্য অনুযায়ী ভারতে ১৪ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছেন। কিন্তু ভারত সরকারের তথ্য মতে ওই সংখ্যা ৪০ হাজারেরও বেশি হবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বায়োমেট্রিক তথ্য নথিভুক্ত করতে সম্প্রতি রাজ্যগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহিষ্কার করার পক্ষপাতি। শরণার্থীদের বোঝা কেইবা বহন করতে চাইবে। তবে বিশ্বের বড় বড় দেশ তো মানবাধিকারের কথা বলে, ন্যায়ের কথা বলে। আন্তর্জাতিক আদালতসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো তো মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার। মিয়ানমার তো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের হত্যা করেছে, দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। এমন বাস্তবতায় প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা তো ন্যায়সঙ্গত ও মানবিক হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু রোহিঙ্গারা কাক্সিক্ষত ন্যায় ও মানবিক আচরণ পাচ্ছে না। আর মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তো কেউ তেমন কিছু বলছে না, এর কারণ কী?

http://www.dailysangram.com/post/348882