১০ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ১১:১৭

সড়ক নিরাপত্তা আইন

বেসামাল পরিবহন খাত

সড়কে মৃত্যুর মিছিল যখন অপ্রতিরোধ্য হারে বেড়ে চলছে ঠিক তখনই নিরাপদ সড়কের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে সারা দেশ। বেপরোয়া চালক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কঠিন ও উপযুক্ত শাস্তির বিধান রেখে আইন পাশের দাবি তোলেন নাগরিকরা। এর মধ্যে তরিঘড়ি করে ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে সড়ক পরিবহন বিল পাস হয়।

সড়ক নিরাপত্তা আইন পাশ হওয়ার পর থেকেই শাস্তি কমানো ও সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা। গত রোববার থেকে সাত দফা দাবিতে ঢাকা বিভাগে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডাকে বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। যদিও গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক শেষে আপাতত ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। এ দিকে ১২ অক্টোবরের মধ্যে আইন সংশোধন করা না হলে আগামী শনিবার থেকে পরিবহন ধর্মঘটসহ বৃহত্তর কর্মসূচির হুমকি দেয় পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ।

নিরাপদ সড়ক সংশ্লিষ্ট আইনজ্ঞ ও সড়ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অনৈতিক আন্দোলনের কারণে সরকার জোড়ালোভাবে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারছে না। সদ্য পাশ হওয়া আইনে যাত্রীদের স্বার্থ পুরোপুরি উপেক্ষা করে মালিক-শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে। এদিকে, তিন দিনের লাগাতর ধর্মঘটে রাজধানীসহ দেশের অনেক অঞ্চলে পণ্য সরবরাহ অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সব ধরণের পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হয়ে দ্রব্যের মূল্য বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষকদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ২৯ জুলাই জাবালে নুর পরিবহনের বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনায় জোড়ালো আন্দোলন হলে ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে সড়ক পরিবহন বিল পাস হলেও প্রেসিডেন্ট বিলটিতে এখনো সই করেননি। সড়ক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মন্দের ভালো হিসেবে জনগণ এটি মেনে নিলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা আইনটি মানতে নারাজ।

নিরাপদ সড়ক সংশ্লিষ্টরা বলেন, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর এমন ঔদ্ধত্য নতুন নয়। গত ১০ মাসে জাতীয় ও অঞ্চলভিত্তিক কমপক্ষে ৭০টি অবরোধ-ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এর আগেও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের প্রাণহানির মামলার রায়ের পরে ধর্মঘট দিয়েছিল তারা।
এ বিষয়ে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের পুরোনো অভ্যাস।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, নতুন পাশ হওয়া আইনে যাত্রী স্বার্থ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। এটি কেবলমাত্র মালিক-শ্রমিদের স্বার্থ রক্ষার সনদ। তিনি বলেন, নতুন আইনে শাস্তির বিধান যথেষ্ট নয়। জনগনকে জিম্মি করে সরকারের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রভাহিত করতে এই আন্দোলন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সংসদে একটি আইন পাস হয়েছে। কেউ বললেই সেই আইনে সংশোধনী আনা যায় না। তিনি বলেন, পণ্য পরিবহন ঐক্য পরিষদের নেতাদের সাথে একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। সেখানে কোন সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। সিদ্ধান্তের বিষয়ে সেতুমন্ত্রী ও আইন মন্ত্রীর সাথে আলোচনা হবে।

পরিবহন মালিক-শ্রমিক সূত্রগুলো বলছে, প্রায়শঃ ধর্মঘট ডাকার ক্ষেত্রে খুলনাভিত্তিক দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, চট্টগ্রাম অঞ্চল ও রাজশাহীভিত্তিক উত্তরবঙ্গের শ্রমিক-মালিক সংগঠনগুলোই বেশি তৎপর। সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত মনঃপূত না হলে অন্য দাবির আড়ালে মালিক-শ্রমিক ধর্মঘট ডাকা হয়।
গত তিন দিন ধরে চলা টানা ধর্মঘটে ঢাকা থেকে পণ্যবাহী ট্রাক, লরিসহ এ জাতীয় গাড়ি ঢাকায় ঢুকতে ও বের হতে বাধা দেয় ধর্মঘট সমর্থনকারীরা। কোথাও কোথাও শ্রমিকদের ধর্মঘটে নামতে বাধ্য করা, গাড়ি ভাংচুর, চলন্ত গাড়ি থামিয়ে চালককে মারধর, এমনকি গাজীপুরে সাংবাদিক ও পথচারীদের মারধর করা হয়। এতে সড়কে ব্যপক যানজট তৈরি হয়। গতকালও কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় চলন্ত গাড়ি থামিয়ে চালকদের মারধর ও গাড়িতে ভাংচুর চালানো হয়।

ধর্মঘটকারী চালকদের অভিযোগ, পথে-ঘাটে পুলিশ তাদের হয়রানি ও অহেতুক মামলা-জরিমানা করে। এক চালক বলেন, আইনে মৃত্যুদন্ড ছাড়াও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ সারা জীবনেও পাঁচ লাখ টাকা জমাতে পারে না।
এদিকে, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনে সমর্থন থাকলেও ধর্মঘটে একাত্মতা প্রকাশ না করে বিরোধিতা করেছে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন)। গত রোববার গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ার সমাবেশ থেকে নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও আগামী শনিবার থেকে বড় আন্দোলনের হুমকি দেয় তারা।
এ প্রসঙ্গে শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, বিরোধীদের অর্থায়নে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে একটি অংশ পণ্য পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে। তারাই মূলত গাড়ি ভাংচুর ও সাধারণ মানুষকে মারধর করে ভীতি তৈরি করছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, যারা ধর্মঘট ডেকেছে, তারা পরিবহন খাতের ক্ষুদ্র একটি অংশ। এর পেছনে বিএনপির হাত রয়েছে।

বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মুকবুল আহমদ বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে তাদের বৈঠক হয়েছে। তিনি সেতুমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে বিষয়টির সমাধান করার আশ্বাসে ধর্মঘট আপাতত স্থগিত করা হয়েছে।
আন্দোলন প্রসঙ্গে সেফ রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অ্যালায়েন্সের আহ্বায়ক এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জনজীবন জিম্মি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা অগ্রহণযোগ্য।
পণ্য-দ্রব্যের সঙ্কট ও দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী বহুমুখী সমিতির সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন ৪শ’ থেকে ৫শ’ ট্রাক, মিটি ট্রাক মালামাল নিয়ে আসে। পরিবহন বন্ধ থাকলে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকায় পণ্যের সংকট দেখা দেবে। এতে খাদ্য দ্রব্যসহ অন্যান্য দ্রব্যের দাম অনেক বেড়ে যাবে। তাতে বাজারে বড় ধরণের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হতে পারে।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/158555