১০ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ১১:১২

ব্যয় মেটাতে প্রয়োজন ৪ হাজার কোটি টাকা

আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে দাবি পূরণে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে সরকারের তরফ থেকে। এসব সুবিধা পাওয়ার শীর্ষে রয়েছে সরকারি চাকরিজীবীরা। পিছিয়ে নেই সরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্তরাও।
ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি শ্রমিকদের। দীর্ঘদিনের বকেয়া অবসর ও কল্যাণ ভাতা দেয়া হচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকদের। গ্রামপুলিশদের জন্য ঘোষণা দেয়া হয়েছে নতুন বেতন স্কেল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ঘোষণার বেশির ভাগই আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চাকরিজীবী তথা ভোটারদের তুষ্ট করার চেষ্টা।
এক হিসাবে দেখা গেছে, নির্বাচনের আগে এসব সুবিধা দিতে গিয়ে সরকারকে অতিরিক্ত প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, শেষ পর্যন্ত এ খরচ মেটাতে হবে বর্তমান বাজেটের থোক বরাদ্দ থেকেই। আর এই বাড়তি ব্যয় চাপ সৃষ্টি করতে পারে আগামীতে ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারের বাজেটে।

সরকারের শেষ সময়ে ঘোষিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে আরও রয়েছে- দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ঝুঁকি ভাতা, শতভাগ পেনশন উত্তোলনকারীদের ফের পেনশন সুবিধা, চাকরিজীবীদের ৫ শতাংশ সুদে গৃহঋণ চালু ও সুদমুক্ত গাড়ির ঋণ, নির্বাচন কমিশনে ২ হাজার নতুন পদ সৃষ্টি ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা।
ভোটের আগে এই যে নানান সুবিধা দেয়া হচ্ছে সেগুলো ভোটারদের তুষ্টির জন্য কিনা জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসনে বেশ কিছু সুবিধার ঘোষণা করা হয়েছে। এসব সুবিধার জন্য সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে। এর সঙ্গে ভোটের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি দাবি করেন, এসব সুবিধা দেয়ার আগে বাজেটের ব্যয় বিশ্লেষণ করে করা হয়েছে। এতে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা বাজেট বাস্তবায়ন ও তদারকি করছেন তারাই এসব সুবিধা ও নির্দেশ জারি করছেন।
তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, নিঃসন্দেহে এসব সুবিধা দেয়ার ফলে বাজেটে চাপ সৃষ্টি করবে। সরকারি চাকরিজীবীদের ৫ শতাংশ হারে গৃহনির্মাণ দিচ্ছে। এ জন্য বাজেটে কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। ফলে এ অর্থের হিসাব মেলাতে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ দিতে হবে অথবা বড় ধরনের যে থোক বরাদ্দ রাখা হয় সেখান থেকে মেটাতে হবে। এসব উদ্যোগের ফলে বাজেটে ব্যয় নির্বাহের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে তার চেয়ে বাড়বে। তবে এসব উদ্যোগের ফলে ব্যয় বাড়লেও শেষ পর্যন্ত ঘাটতি বাজেটের লক্ষ্যমাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন নাও হতে পারে।

দুদকের ঝুঁকি ভাতা : দুদকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য গত ২০ আগস্ট ঝুঁকি ভাতা ঘোষণা করা হয়। সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৪শ’ টাকা এবং সর্বনিু ২৬শ’ টাকা নির্ধারণ করে ভাতা ঘোষণা করা হয়। জাতীয় বেতন স্কেলের ১০ম থেকে ২০তম পর্যন্ত গ্রেডে কর্মরত দুদকের চাকরিজীবীরা এ ভাতা পাবেন। নির্বাচনের আগে এ সুবিধা দিতে সরকারের বছরে ব্যয় হবে ১৫ কোটি টাকা। এ সুবিধা পাবেন দুদকের ৭০১ জন কর্মকর্তা।
গ্রামপুলিশের নতুন বেতন স্কেল : দেশব্যাপী ৪৫ হাজার গ্রামপুলিশ কাজ করছে। দীর্ঘদিন পর তাদের বেতন বাড়ানোর প্রস্তাবটি সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। সর্বোচ্চ ৭৬ শতাংশ বেতন বাড়ছে এ বাহিনীর। নতুন স্কেলে দফাদারের মাসিক বেতন ৩৪শ’ টাকা থেকে বেড়ে ৬ হাজার টাকা এবং মহল্লাদারের বেতন ৩ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা। এটি বাস্তবায়ন করতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে ১৫৭ কোটি টাকা।

অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি শিক্ষকদের ভাতা : নির্বাচনের আগেই অবসরপ্রাপ্ত প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী (এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের) পাচ্ছেন ‘অবসর’ ও ‘কল্যাণ’ ভাতা। ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত অবসরপ্রাপ্ত আবেদনকারীরা এ সুবিধা পাবেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এটি বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। এ জন্য ব্যয় হবে ৭৫৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা দেবে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ২৫৭ কোটি টাকা দেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
পেনশন সুবিধা : সরকারের শেষ সময়ে ২০ হাজার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী যারা শতভাগ পেনশন সুবিধা উত্তোলন করেছেন তাদের পুনরায় পেনশনের আওতায় আনা হচ্ছে। যাদের অবসরের বয়স ১৫ বছর কেটেছে, তারাই এ সুবিধা পাবেন। এ সুবিধা বাস্তবায়নে অতিরিক্ত ব্যয় হবে ১৪৫ কোটি টাকা। গত ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে তা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা : দীর্ঘদিন পর সরকার সর্বনিু ৮৩০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ মজুরি ১১২০০ টাকা নির্ধারণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির বিল পাস করেছে সংসদে। ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে মজুরি এবং ভাতা ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। আগে এসব শ্রমিক মজুরি ন্যূনতম ৪ হাজার ১৫০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৬০০ টাকা পেতেন। গত তিন বছরের বকেয়া বাড়তি বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পরিশোধে সম্ভাব্য ব্যয় হবে ১৩শ’ কোটি টাকা।

চাকরিজীবীদের গৃহঋণ চালু : ১ অক্টোবর থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ৫ শতাংশ সরল সুদে সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত গৃহনির্মাণ ঋণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সর্বনিু ঋণ ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৫ বছর চাকরি আছে এমন চাকরিজীবী বর্তমানে ৭ লাখ। তাদের মধ্যে ১০ শতাংশকে ঋণ দেয়া হলেও বছরে আবেদনকারী হবে ৭০ হাজার। গড়ে প্রতিজনের ঋণ ৪০ লাখ টাকা ধরলেও বছরে দাঁড়াবে ২৮ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে সরকারকে বছরে এক হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিতে হবে।
গাড়ির জন্য সুদমুক্ত ঋণ : প্রশাসনের উপসচিব থেকে শুরু করে উচ্চপদের সরকারি চাকরিজীবীদের গাড়ি কিনতে এককালীন ৩০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে সরকার। ‘বিশেষ অগ্রিম’ নামের এ ঋণের বিপরীতে কোনো সুদ দিতে হবে না। আবার কেনা গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, তেল খরচ ও চালকের বেতন বাবদ আরও ৫০ হাজার টাকা মাসে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে প্রশাসনে ১ হাজার ৫৫২ জন উপসচিব আছেন। তাদের গাড়ি কেনার ঋণ দিতেই সরকারের ব্যয় হবে ৪৬৫ কোটি টাকা। চালকদের বেতনসহ অন্য সব খরচ মিলিয়ে উপসচিবদের জন্যই সরকারের আরও ব্যয় হবে বছরে ৯৩ কোটি টাকা। ফলে এ খাতে মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৫৮৫ কোটি টাকা।

বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ হচ্ছে : নির্বাচনী বছরে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১৪০ শতাংশ ও সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১১৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিগগিরই এ প্রস্তাব অনুমোদন হবে বলে জানা গেছে। কারণ নির্বাচনের আগেই সরকার এ সুবিধা দিতে চাচ্ছে। এ সুবিধা পাবে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার অনুদানপ্রাপ্ত ৪ হাজার ৫২৯ জন শিক্ষক। বর্তমানে প্রধান শিক্ষকরা ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং জুনিয়র শিক্ষক ও ক্বারিরা ২ হাজার ৩০০ টাকা করে পাচ্ছেন। নতুন প্রস্তাবে প্রধান শিক্ষকরা বেতন পাবেন ৬ হাজার এবং জুনিয়র শিক্ষক ও ক্বারিরা পাবেন ৫ হাজার টাকা করে। এতে সরকারের সম্ভাব্য ব্যয় হবে বছরে ৩০ কোটি টাকা।
নির্বাচন কমিশনে নতুন পদ সৃষ্টি : সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে (ইসি) ২ হাজার জনবল নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আগেই তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বর্তমান প্রায় ৪ হাজারের বেশি লোকবল কাজ করছে নির্বাচন কমিশনে।
এছাড়া বেসরকারি খাতে যেসব সুবিধার ঘোষণা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে আছে-
পোশাক শ্রমিকদের মজুরি : সরকারের শেষ সময়ে পোশাক শ্রমিকদের নিুতম মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে ন্যূনতম ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে এ মজুরি ঘোষণা দেয়া হয়। এতে সরাসরি উপকৃত হবে এ শিল্পের ৩৫ লাখ শ্রমিক।
অ্যালুমিনিয়াম শিল্পে মজুরি : অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল শিল্পের শ্রমিকদের নিুতম মোট মজুরি ৮ হাজার ৭শ’ টাকা নির্ধারণ করেছে। প্রতি বছর এটি মূল মজুরির ৫ শতাংশ হারে বাড়বে। এতে দুই শতাধিক অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্ড এনামেল শিল্পের প্রায় ৫০ হাজারের ওপরে শ্রমিক উপকৃত হবেন।
ব্যবসায়ীদের খুশি রাখার উদ্যোগ : ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে ভোটের আগে বড় ধরনের ছাড় দিয়েছে সরকার। বাজেট পাসের দু’মাসের মাথায় পোশাক রফতানিকারকদের উৎসে কর ও কর্পোরেট কর কমানো হয়। এ ছাড়া ওষুধসহ ৯টি খাতে নগদ সহায়তা দেয়া হয়েছে।
অন্যান্য সুবিধা : কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর বা কৃতিত্বপূর্ণ কাজের সম্মানী প্রদান, পুলিশের এসআই ও সার্জেন্টদের ঝুঁকি ভাতা প্রদান, গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৪শ’ স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/99246