১০ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ১১:০৩

শেষবেলায় প্রকল্প পাস ও সংশোধনের হিড়িক

৪ একনেকেই ৬৬ প্রকল্প অনুমোদন ও সংশোধন

বর্তমান সরকারের শেষবেলায় ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েক মাস আগে এখন প্রকল্প অনুমোদন এবং সংশোধনের হিড়িক পড়েছে। শুধু চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৯টি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) মোট ১০৯টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আর পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি থেকে চূড়ান্ত হয়েছে এমন প্রকল্প প্রস্তাবনার সংখ্যা শতাধিক। রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে এসব প্রকল্প সমীক্ষা বা সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই হচ্ছে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, নির্বাচনের আগের দু’তিন মাস রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বেসরকারি খাত বিনিয়োগে আসতে চায় না। তারা ওই সময়টা পর্যবেক্ষণ করেন। তাই এই সময় উন্নয়ন কার্যক্রমকে গতিশীল রাখতেই সরকারকে তার বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হয়। বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদদের মতে, এসব প্রকল্পের বেশির ভাগই ভোটার তুষ্ট করতে নির্বাচনী প্রকল্প। রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের শেষবেলাতে এসে এর আগেও এমনিভাবে প্রকল্প অনুমোদনের একটা হিড়িক পড়েছিল; কিন্তু এতে করে দুর্বল ও কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও অনুমোদন পেয়ে যায়। বাস্তবায়নের পর্যায়ে এ ক্ষেত্রে এই সময়ে সরকারি অর্থের অপচয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি কাজের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন থাকে।

আগামী ২৮ জানুয়ায়ির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সে হিসেবে আগামী ১০ নভেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা আছে। আর বিধান অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার পর নতুন কোনো প্রকল্প অনুমোদন দেয়া যাবে না। তাই তফসিলের আগেই উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন ও সংশোধন করাতে চাচ্ছে সবাই। আর এ কারণে পিইসিতে এখন প্রকল্পের চাপ অনেক বেশি। বাধ্য হয়ে পরিকল্পনা কমিশনকে বিশেষ একনেক করার পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।
পরিকল্পনা কমিশন ও পিইসি সূত্র বলছে, ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের শতাধিক প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। যাদের অনেকগুলোই একনেকের অনুমোদনের জন্য চূড়ান্ত হয়ে আছে। কিছু প্রকল্প পিইসিতে ছাড়পত্রের অপেক্ষায় আছে। আবার এসব প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনের কাছে পাঠিয়েই একনেকে উপস্থাপনের জন্য দৌড়ঝাঁপ চলছে সংশ্লিষ্টদের। সর্বশেষ চার একনেকেই ৬৬ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়।

এ দিকে চলতি অক্টোবর মাসের একটি একনেকেই ২০টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর বাইরেও চারটি রয়েছে, যা ৫০ কোটি টাকার নিচে বলে পরিকল্পনামন্ত্রী নিজেই অনুমোদন দিয়েছেন। এ ছাড়া চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই থেকে গত ৯ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৯টি একনেকে মোট ১০৯টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। যার জন্য মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার ৬৯৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এখানে গড়ে ১২টির বেশি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। প্রকল্পের প্রস্তাবনাগুলো এতো বেশি আসছে, যা গত এক বছরেও এমন ছিল না। আবার অনুমোদন পাওয়ার সাথে সাথে তার প্রশাসনিক অনুমোদনের জন্য অর্থ ছাড় করার জন্য দৌড়াদৌড়ি চলছে বলে বিভিন্ন বিভাগসংশ্লিষ্টরা জানান। কমিশনে সরেজমিন বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান, মেয়র, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের পতাকাবাহী গাড়িও চোখে পড়েছে। প্রকল্প একনেকে উপস্থাপনের জন্য বিভিন্ন পর্যায় থেকেও একটা চাপ থাকে বলে জানান কমিশন-সংশ্লিষ্টরা।

নির্বাচনের আগে এভাবে প্রকল্প অনুমোদনের হিড়িক কেনÑ জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, প্রকল্প অনুমোদন দেশের স্বার্থেই নেয়া হচ্ছে। প্রয়োজন হলে প্রতিদিনই অনুমোদন হতে পারে। তফসিল পর্যন্ত একনেক চলবে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী জানান, দরকার হলে তফসিলের পরেও প্রকল্প অনুমোদন হতে পারে। এসব রুটিন ওয়ার্কের বাইরে নয়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে. মুজেরির সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, রাজনৈতিক আগ্রহের প্রকল্পগুলো ভৌত অবকাঠামো, কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী উন্নয়ন বিভাগেই বেশি থাকে। আর শেষ মুহূর্তে এসে একটু চাপ তো থাকবেই। কারণ নির্বাচনের আগে প্রকল্পগুলো অনুমোদন করা গেলে সরকারেরও ইতিবাচক প্রভাব থাকে। এ ক্ষেত্রে সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ ও যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প গ্রহণ করা না হলে বাস্তবায়নে সঠিক মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। সরকারি অর্থের অপচয় হতে পারে।

বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, নির্বাচনের আগে এসব বড় ব্যয়ের প্রকল্প যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের কল্যাণের জন্য হয় তাহলে অবশ্যই ভালো; কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রকল্পের টাকা যদি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছে চলে যায় তাহলে জনতুষ্টি হবে না। আর এটা হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। কারণ এ সময় নজরদারিটা তেমন একটা জোরালো থাকে না।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, নির্বাচনের আগে এসব প্রকল্প নেয়ার অর্থই আগামী জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করা। অনেক দিন ধরেই তো সরকার ক্ষমতায়। আগে তারা এসব কেন নিল না? নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এসব প্রকল্প নেয়া মানে অর্থের অপচয়। নির্বাচনী ডামাডোলে এসবের তেমন কোনো খোঁজ না থাকাই স্বাভাবিক। কতটুকু কাজ হলো তার খোঁজ নেয়ারও কেউ থাকবে না। এসব সত্যি অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত বলে তিনি মনে করেন।


http://www.dailynayadiganta.com/first-page/355835