১০ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ১১:০২

রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দিয়ে ঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে টাকা লুট

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। সরকারি ব্যাংকগুলো তাদের মূলধন খেয়ে ফেলেছে। আর এ সব ব্যাংকগুলোতে যেন লাল বাতি না জ্বলে সেজন্য জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। গত নয় বছরে অর্থ সংকটে ভুগতে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ মূলধন যোগান দিতে হয়েছে। যার পরিমাণ সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ব্যাংক খাতে অন্ধকার যুগ নেমে আসে। রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং এমডি নিয়োগ দিয়ে ঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে সব টাকা লুট করে নেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনিয়মের মাধ্যমে এ সব ঋণ দেয়ায় ব্যাংকগুলো তা আদায় করতে পারছে না। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে সরকারের প্রভাবশালী মহলের ইন্ধনে এসব ঋণ ছাড় করানোর ফলে তা এখন অধিকাংশই খেলাপির খাতায় চলে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে এতো বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নেয়ায় ব্যাংকগুলোর প্রায় সব সূচকই এখন নিম্নমুখী। একদিকে পুরনো খেলাপির চাপ, অন্যদিকে নতুন করে বিপুল অঙ্কের খেলাপি, প্রভিশন ঘাটতি, তারল্য সংকট, বড় ধরনের আর্থিক লোকসানের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে লোকসানি শাখার সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে একটি সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, জুন শেষে মূলধন সংক্রান্ত শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সাতটি ব্যাংক। এর অর্থ হল, এ ব্যাংকগুলোকে আবারও মূলধন সরবরাহের জন্য জনগণের করের টাকার ওপর নির্ভর করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। তথ্যে আরও দেখা যায়, জুন শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ সর্বোচ্চ ৮ হাজার ১০ কোটি টাকা। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৬ হাজার ৬০২ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩ হাজার ১০৬ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৬৪৫ কোটি টাকা। প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, মোট খেলাপি ঋণের ৩২ শতাংশ ১০০ শীর্ষ খেলাপির কাছে আটকে আছে। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের। এ নিয়ে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে অনিয়মের কারণে ঋণের একটি অংশ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সুশাসনের অভাবে ধুঁকতে থাকা এ প্রতিষ্ঠানগুলো সংকট থেকে উঠে আসতে পারছে না। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও স্থানীয় ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের কাছে এমনই একটা বার্তা পৌঁছে গেছে। যা বৈদেশিক বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত দ্রুত সংকট উত্তরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংকিং খাতের করুণ পরিণতি শুরু হয় ২০০৯ সালে। রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং এমডি নিয়োগ দিয়ে ঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে সব টাকা লুট করে নেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের এমডি-চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার পর থেকে এমন দশা সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতি এতটা প্রকট ছিল না। মূলত খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তাই মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। সূত্র জানায়, ব্যবসার পরিবর্তে এসব ব্যাংক এখন মূলধন জোগান নিয়েই চিন্তিত। চলতি বছরের শুরুতে মূলধন ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। কারণ ঘাটতিতে থাকায় এসব ব্যাংক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আর খেলাপি বাড়লে মান অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে হয়। সে কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। আর বাস্তবতা হলো এভাবে একদিকে জনগণের জমানো টাকা ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ হিসেবে দেয়া হচ্ছে একশ্রেণীর মাফিয়ার হাতে যা আদায়ও করা যাচ্ছে না। বিপরীতে সরকারের তহবিল থেকে টাকা নিয়ে মূলধন ঘাটতি মেটাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সরকারি ব্যাংকগুলো। এ টাকাও জনগণের ট্যাক্সের টাকা। অথচ জড়িতদের কারও কিছুই হচ্ছে না। মাঝখানে কৌশলে জনগণের পকেট কাটা হচ্ছে। তাই যতদিন ব্যাংকিং সেক্টরের এসব ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিচার না হবে ততদিন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ও ঋণ অবলোপন বাড়তেই থাকবে। অভিযোগ আছে, সরকারি দলের প্রভাবশালীরা এসব ঋণ অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। সে কারণে সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণের নামে সব টাকা বের করে নেয়া হয়েছে। এসব টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ রাজনীতির ছত্রছায়ায় একটি প্রভাবশালী মহল ব্যাংকে দুর্নীতি করেছে। এর দায়ভার পুরোপুরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায়। কারণ অর্থমন্ত্রী নিজেই সরকারি ব্যাংকে এমডি-চেয়ারম্যান এবং পরিচালক নিয়োগ দেন। তার মতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে দেয়া দরকার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে দুর্নীতি, অনিয়মের মাধ্যমে লুট হয়ে যাওয়া টাকার ঘাটতি মেটাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রতিবছর ব্যাপকহারে মূলধন যোগান দিয়ে যাচ্ছে। সরকারি ব্যাংকগুলোকে ২০১১-১২ অর্থবছরে বাজেট থেকে ৩৪১ কোটি টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৫৪১ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫ হাজার ৬৮ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেয় সরকার। এছাড়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মূলধন জোগান দিয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। ওই বছর ব্যাংকগুলো চেয়েছিল সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এ অর্থবছরেও দেয়া হয়েছে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ বর্তমানে টানা ৯ বছর দেশ পরিচালনা করছে। শুরুটা হয়েছিল ২০০৯-এ। অভিযোগ আছে, ওই সময় সরকার গঠনের পরপরই কিছু দলবাজ লোক ব্যক্তিস্বার্থে সরকারি ব্যাংকগুলোকে টার্গেট করে। দেখা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় চেয়ারম্যান, পরিচালক এবং এমডি নিয়োগ দেয়া হয়। এ সময় সেক্টরটিতে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি-লুটপাট করা হয়। সূত্রগুলো বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল ছিল ব্যাংকিং খাতের অন্ধকার যুগ বা দুর্দশাগ্রস্ত সময়। সে সময়ে হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি এবং বেসিক ব্যাংকে ব্যাপক হারে লুটপাট করা হয়। পরবর্তিতে সে দুর্নীতির ঢেউ রাষ্ট্রয়ত্ত অন্যা ব্যাংকগুলোকেও গ্রাস করে। দুর্নীতি অনিয়ম থেকে রক্ষা পায়নি বেসরাকারি খাতের মালিকানাধীন ব্যাংকও। সে অমানিশা দিনদিন আরও ঘনিভূত হচ্ছে।
এদিকে সম্প্রতি মূলধন ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি। কমিটির প্রতিবদেন বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোর দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে লোকসান হওয়ার ফলে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে সরকারকে জাতীয় বাজেট থেকে বরাদ্দের মাধ্যমে ঘাটতি পূরণের জন্য প্রায়ই ব্যাংক অনুরোধ করে। এ ধরনের ঘাটতি পূরণের প্রবণতা বন্ধ করতে যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যেসব ক্ষেত্রে মূলধন ঘাটতিপূরণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে সেসব ক্ষেত্রে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের শর্তসাপেক্ষে ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে। তবে এই প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বেসরকারি ব্যাংকের প্রভিশন রাখার বাধ্যবাধকতা শিথিল করা আইনানুগ হয়নি বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে উপ-কমিটি।

এ বিষয়ে সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলোর মূলধন যোগান দেওয়ার মধ্য দিয়ে লোকসানের রাষ্ট্রীয়করণ করা হচ্ছে। যা কখনো কাম্য হতে পারে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে একটি সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এটা করতে পারলে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
সিপিডির গবেষক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, প্রতিবছর সরকারি ব্যাংকগুলোকে বাজেট থেকে দেয়া হয় মূলধনের ঘাটতি পূরণে বরাদ্দের নামে লাইফ সাপোর্ট। সরকারের এ ধরনের প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসা উচিত।

http://www.dailysangram.com/post/348730