৯ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:০৯

গায়েবি মামলায় পুলিশের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন হাইকোর্টের

দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় চার হাজার মামলায় মৃত ব্যক্তি কিংবা সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের আসামী করায় পুলিশের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, এ ধরনের মামলায় (গায়েবি) পুলিশের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। খন্দকার মাহবুব হোসেনের (সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান) বিরুদ্ধে এমন (গায়েবি) মামলা হলে জনগণের কাছে কি মেসেজ যাবে?
গতকাল সোমবার গায়েবি মামলায় তিন লাখেরও বেশি লোককে আসামী করার বিষয়ে তদন্ত চেয়ে রিটের শুনানিকালে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ প্রশ্ন তোলেন। আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, সিনিয়র অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রমুখ। তাদের সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. মাসুদ রানা, ব্যারিস্টার একেএম এহসানুর রহমান প্রমুখ। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল।

শুনানির শুরুতে কয়েকটি মামলার এজাহার পর্যবেক্ষণ করে হাইকোর্ট বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতো লোক ককটেল বিস্ফোরণ করবে এটাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? এটা ঠিক না। এ ধরনের মামলায় (গায়েবি) পুলিশের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতো লোকদের বিরুদ্ধে এমন মামলা হলে জনগণের কাছে কি ম্যাসেজ যাবে?

দুপুর আড়াইটার দিকে শুনানির শুরুতে বিএনপির নেতাকর্মীদের পক্ষের আইনজীবী ড. কামাল হোসেন আদালতে বলেন, গত মাসের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার গায়েবি মামলা করা হয়েছে। অনেক লোককে আসামী করা হয়েছে যারা মৃত ব্যক্তি। আবার অনেকে এ সময় হজ্বে ছিলেন। অনেকে দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে জীবনযাপন করছেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন, আব্দুর রেজাক খানকে ককটেল বিস্ফোরণ মামলায় আসামী করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, মৃত ব্যক্তির নামে মামলা করা হয়েছে। তাহলে মৃত ব্যক্তি কি কবর থেকে উঠে এসে ককটেল বিস্ফোরণ করে গেছেন? এসব হাস্যকর মামলা করা হলে জনগণের কাছে কী ম্যাসেজ যাবে?
এ সময় আদালত ড. কামাল হোসেনকে বলেন, আপনারা কি চান?
জবাবে ড. কামাল হোসেন বলেন, আমরা এসব গায়েবি মামলার বিষয়ে তদন্ত কমিশন চাই।
এ সময় আদালত রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুলকে বলেন, খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতো লোক ককটেল বিস্ফোরণ করবে এটাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? এটা ঠিক না।

শুনানির শুরুতে কয়েকটি মামলার এজাহার পর্যবেক্ষণ করে হাইকোর্ট বলেন, এ ধরনের মামলায় (গায়েবি) পুলিশের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতো লোকদের বিরুদ্ধে এমন মামলা হলে জনগণের কাছে কী ম্যাসেজ যাবে?
জবাবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল আদালতকে বলেন, উনি (খন্দকার মাহবুব হোসেন) তো শুধু আইনজীবীই নন, একটি রাজনৈতিক দলের পদধারী।
এপর্যায়ে আদালত বলেন, এটা কী বললেন? তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না, এটা তো আইনে নেই। আগে আইনজীবীরাই বেশি রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।
শুনানির শেষপর্যায়ে এসে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, মাই লর্ড আমার কিছু সাব-মিশন আছে। আমি আগামীকাল (মঙ্গলবার) বলব।

এরপর অ্যাটর্নির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ মঙ্গলবার আদেশের জন্য দিন ধার্য করা হয়।
মামলার বিবরণে জানা যায়, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় চার হাজার মামলা হয়। ১০ বছর আগে মারা গেছেন এমন লোকদেরও এসব মামলায় আসামী করা হয়েছে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনকে একই জায়গায় পরপর তিন থেকে চারদিনে চার থেকে পাঁচটি মামলায় আসামী দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এর প্রত্যেকটি মামলায় তিনি ককটেল বিস্ফোরণের আসামী। তিনি সন্ধ্যার পরে গিয়ে ককটেল ছঁড়ে মেরেছেন। এ ছাড়া ২০০৭ সালে মারা গেছেন, কিংবা চলতি বছর হজ্বে ছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে রয়েছেন- এমন লোকদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে।

এ নিয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট দায়ের করেন অ্যাডভোকেট এ কে খান। সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, সানাউল্লাহ মিয়ার পক্ষে এই রিট দায়ের করা হয়।
রিটে গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সারা দেশে বিএনপির সিনিয়র আইনজীবীসহ বিভিন্ন নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে করা চার হাজার মামলা এবং তিন লাখেরও বেশি লোককে আসামী করার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত যত গায়েবি মামলা করা হয়েছে সেগুলোর তদন্ত বন্ধ এবং এ গায়েবি মামলাগুলোর বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক কমিটি করে ঘটনার তদন্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী সময়ে যেন এ ধরনের মামলা দেয়া না হয়, তার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশী ক্ষমতা অপব্যবহার করে গায়েবি বা মিথ্যা মামলা দায়ের করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, রিটে সে বিষয়ে রুল জারির আরজি জানানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার, ডিএমপি রমনা জোনের ডেপুটি ও অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার, রমনা, পল্টন ও শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ মোট নয়জনকে এই রিটে বিবাদী করা হয়েছে।

http://www.dailysangram.com/post/348600