৮ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ১০:২৫

গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ১২শ’ কোটি টাকার জমি অবমুক্ত করা নিয়ে নানা প্রশ্ন

শুরুটাই ছিল অনিয়মে ভরা। সরকারের অধিগ্রহণ করা জমি কেনা হয় অনিয়মতান্ত্রিকভাবে। এখন ওই অধিগ্রহণ করা প্রায় ২০ একর জমি অবমুক্ত করতে চলছে লবিং। যে জমির মূল্য এখন ১২০০ কোটি টাকা। উচ্চমূল্যের এ জমি অবমুক্ত নিয়ে অর্ধ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি এখন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মুখে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর পরই সরকারের অধিগ্রহণ করা এ জমি নিজেদের বাগে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে সাগুফতা হাউজিং। এজন্য ২০টি মামলা করেছে কোম্পানিটি।
মামলা দিয়ে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভয় দেখানোর পাশাপাশি কিছু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করার অভিযোগ উঠেছে ওই হাউজিং কোম্পানির বিরুদ্ধে।

এ জন্য কোম্পানিটির পক্ষ হয়ে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে শক্তিশালী একটি ‘কর্মকর্তা গ্রুপ’ সক্রিয়। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে চুক্তিতে নিয়োজিত এক শীর্ষ কর্মকর্তা জমি অবমুক্তির বিষয়টি দেখভাল করছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ঢাকা ডিভিশন-১ এর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জিয়াউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, সাগুফতা হাউজিং মিরপুরের বাউনিয়া মৌজার ১৯ দশমিক ৬৬ একর জমি অবমুক্তি চায়। এ পর্যন্ত তারা ২০টি মামলা দায়ের করেছে। এর মধ্যে আমার বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা করেছে।

সরকারি স্বার্থ দেখতে গেলে এমন মামলা দায়ের হয়। এটাতে কিছু করার নেই। তিনি জানান, অনৈতিক কার্যকলাপে রাজি না হওয়ার কারণে সম্প্রতি আমাকে বগুড়া বদলি করা হয়েছে। এ বিষয়টি আমি লোক মারফত শুনেছি। এখনো চিঠি হাতে পাইনি। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, মিরপুর এলাকার তিন হাজার একশ’ ৯৮ একর জমি স্বাধীনতার আগেই অধিগ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে এল.এ.কেইস নং-১৩/৫৯-৬০ তে ১৪৬০ একর, এল.এ.কেইস নং-৫/৭২-৭৩ তে ১০৭৬ একর এবং এল.এ.কেইস নং-৯০/৬৫-৬৬ তে ৬৬২ একর জমি রয়েছে। এসব জমির মধ্যে বাউনিয়া মৌজায় ১৬৮ একর জমির উপর স্বপ্ননগর ফ্ল্যাট প্রকল্পের মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদিত আছে। এরমধ্যে ৪০ একর জমির ওপর পিপিপি’র অধীনে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত নাগরিকদের জন্য আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হচ্ছে। বাকি একশ’ একর জমিতে সমন্বিত নগর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশল দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, স্বপ্ননগরে মধ্যবিত্তের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে। স্বপ্ননগর-১ ও স্বপ্ননগর-২ প্রকল্পের অধীনে তৈরি হচ্ছে দুই হাজার ৬০০ ফ্ল্যাট। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, স্বপ্ননগরের পাশেই মিরপুর ডিওএইচএস আবাসিক প্রকল্প।

এ প্রকল্প ও এর আশেপাশে প্রতি কাঠা জমি এক কোটি টাকা বেচাকেনা হয়। তাই সাগুফতা হাউজিংয়ের অবমুক্তি চাওয়া ১৯ একর বা ১১৫০ কাঠা জমির মূল্য কম করে হলেও ১২০০ কোটি টাকা। মিরপুর জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ২৫শে এপ্রিল জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের স্মারক নং-জাগৃক/নোটফাইল-০৪/২০১৭/১৯০, তারিখ-২৫/০৪/২০১৮ এর মাধ্যমে ঢাকা ডিভিশন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরে একটি চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে ঢাকার এল.এ.কেইস ৫/৭২-৭৩ এবং এল.এ.কেইস-১৩/৫৯-৬০ এর মাধ্যমে মিরপুরের বাউনিয়া মৌজার সি.এস দাগ নং- ৩১২৪, ৩১২৭, ৩১৩১, ৩২৮০ এবং ৩৪১৫ এর জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন ও সাপোর্টিং ডকুমেন্ট পাঠাতে বলা হয়। এর ভিত্তিতে অতি দ্রুততার সঙ্গে সার্ভে রিপোর্ট এবং প্রকৌশলীদের কাছ থেকে রিপোর্ট নেন সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী তানজিলা খানম। অভিযোগ রয়েছে, সার্ভেয়ার ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীদের কাছ থেকে রিপোর্ট নিয়েও নিজের মতো করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দপ্তরে চিঠি পাঠান নির্বাহী প্রকৌশলী তানজিলা। নিচের কর্মকর্তাদের রিপোর্ট এক্ষেত্রে গ্রাহ্য করেননি তিনি। এর মধ্যে ৭ই জুন এক ভাষায় চিঠি পাঠিয়ে ১১ই জুন আলাদা আলাদা স্মারকে চিঠি পাঠান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সমন্বয় ও উন্নয়নের দপ্তরে। ৭ই জুন জারি করা এক চিঠিতে তানজিলা খানম বলেন, ১৯ দশমিক ৬৬ একর জমিসহ ১৬৮ একর সম্পত্তি জেলা প্রশাসক, ঢাকা কর্তৃক ১৯৯০ সালের ৩০শে এপ্রিল ও ২০১৫ সালের ১০ই মার্চ সীমানা নির্ধারণসহ বাস্তব দখল হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, এলাইনমেন্টভুক্ত সব জমি সরকার বা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের জমি যা গেজেটভুক্ত আছে।

১১ই জুন একই বিষয়ে আলাদা আরেকটি চিঠি পাঠান নির্বাহী প্রকৌশলী তানজিলা খানম। ওই চিঠিতে প্রথমে উল্লেখ করা বক্তব্যগুলো চেপে যাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রথম চিঠি’র পর পরই সাগুফতা হাউজিংয়ের সঙ্গে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের মোটা অঙ্কের দফারফা হয়। দফারফার পর সাগুফতা হাউজিংয়ের দাবিকৃত জমি অবমুক্তি করার ফাইল অনেক দূর এগিয়ে যায়। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামানসহ কয়েক জন কর্মকর্তা সাগুফতার জমি অবমুক্ত করার বিষয়ে মাঝে মধ্যেই বৈঠকে বসতেন। ঊর্ধ্বতনদের এ বৈঠক নিয়েও রয়েছে রসালো আলোচনা। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিজেদের দফারফার বিষয়টি অস্বীকার করে সাগুফতা হাউজিংয়ের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু শোয়েব খান মানবজমিনকে বলেন, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ আমাদের চির শত্রু। তাদের ম্যানেজ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। এটা কীভাবে হয়?

 

http://mzamin.com/article.php?mzamin=139215