ছবি: সংগৃহীত
৮ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ১০:২২

পদ্মার ভাঙনে রাজবাড়ীতে বড় ক্ষতির শঙ্কা

১০০ বছরের গ্যারান্টি দেয়া বাঁধ ৮ বছরেই ধ্বংসের মুখে * নাব্য থাকা সত্ত্বেও নদীতীরে ড্রেজিং করায় ভাঙন ঝুঁকি বেড়েছে * নদীভাঙন ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৩ হাজার পরিবার

পদ্মার প্রবল স্রোত ও ঘূর্ণনের কারণে আরও বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কার মুখে রাজবাড়ী জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, এখনই পদক্ষেপ না নিলে পানির স্রোতে জেলার সরকারি ও বেসরকারি বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বিলীন হয়ে যেতে পারে।

ইতিমধ্যেই পদ্মার রাজবাড়ী অংশের ৮৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে কয়েকটি স্থানে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে তীরবর্তী ১১টি ইউনিয়ন পরিষদের বেশ কিছু এলাকা।
ঘরবাড়ি ও জায়গা-জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে পাঁচ উপজেলার প্রায় ১৩ হাজার পরিবার। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, পানি কমে যাওয়ার পরও ভাঙন দেখা দিতে পারে। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো পৃথক দুই চিঠিতে রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মো. শওকত আলী এসব আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
জেলা প্রশাসকের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, রাজবাড়ী জেলার স্থায়ী বাঁধের গ্যারান্টি ১০০ বছর দেয়া হলেও সেটি এখন ৮ বছরেই ধ্বংসের মুখে। এছাড়া নদীর মাঝখানে ড্রেজিং না করে নাব্য থাকা সত্ত্বেও রাজবাড়ী প্রান্তে খনন করায় নদীভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞ দল দিয়ে শহর রক্ষা বাঁধ সমীক্ষা এবং পদ্মা ও গড়াই নদীর তীরে ভাঙন এলাকায় আপদকালীন জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করেছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি)। একই বিষয় উল্লেখ করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও চিঠি দিয়েছেন তিনি।

জানতে চাওয়া হলে রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মো. শওকত আলী যুগান্তরকে বলেন, পানি বাড়ার সময় নদীভাঙনের তীব্রতা বেশি ছিল। বর্তমানে পানি স্তর নিচে নামার সঙ্গে ভাঙনের তীব্রতা কমলেও এখনও ভাঙছে।
এবার ১১টি ইউনিয়নের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারলে নদীভাঙন বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তার। তিনি বলেন, নদীভাঙন রোধে জিও ব্যাগ ফেলাসহ আপদকালীন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
এবার পদ্মার নদীর তীব্র স্রোতের কবলে পড়ে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়ায়ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কয়েক হাজার পরিবার তাদের জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি হারিয়ে পথে বসেছে। এর রেশ ফরিদপুর ও মাদারীপুর পর্যন্তও গড়িয়েছে। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন।
পদ্মার গতি প্রবাহ বদলের ফলে পাটুরিয়া থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত আরও কয়েক বছর ভাঙতে পারে বলে আশঙ্কা নদী বিশেষজ্ঞ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. মমিনুল হক সরকারের।

তিনি বলেন, পদ্মার পাটুরিয়া-গোয়ালন্দ পর্যন্ত নদী প্রবাহের গতিপথে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এক সময়ে এ এলাকায় নদীর প্রশস্ততা ছিল ৪-৫ কিলোমিটার, এটি কমে ২ কিলোমিটারের কাছাকাছি এসে গিয়েছিল। এখন নদী ফের চওড়া হচ্ছে। এ কারণেই নদীভাঙন। এ অবস্থা আরও কয়েক বছর অব্যাহত থাকতে পারে।

ডিসি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৪টি উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন হচ্ছে- পাংশা উপজেলার বাহাদুরপুর ও হাবাসপুর, কালুখালী উপজেলার কালিকাপুর ও রতনদিয়া, সদর উপজেলার চন্দনি, খানগঞ্জ, মিজানপুর ও বরাট এবং গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম, ছোটভাটলা ও দৌলতদিয়া।
এদিকে পানি সম্পদ সচিবকে দেয়া চিঠিতে জেলা প্রশাসক বলেছেন, এ মৌসুমে পদ্মার তীরবর্তী এলাকায় স্রোতের ঘূর্ণন থাকায় স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত রাজবাড়ী শহর রক্ষা বাঁধের কয়েকটি জায়াগায় ভাঙন ধরেছে। এটি চলতে থাকলে রাজবাড়ী শহরে পানি ঢুকে সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা, বসতবাড়ি, স্কুল-কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাস্তা-ঘাটসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের চিঠির বরাত দিয়ে ওই চিঠিতে এ পর্যন্ত নদীভাঙনে রাজবাড়ী সদর, পাংশা, কালুখালী, গোয়ালন্দ ও বালিয়াকান্দি উপজেলার ক্ষয়ক্ষতির সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। চিঠিতে নদীভাঙন ঠেকাতে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করা হয়।
অপরদিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবকে দেয়া চিঠিতে পদ্মা ও গড়াই নদীভাঙন কবলিত ও ভাঙন ঝুঁকিতে থাকা ৩২ কিলোমিটার এলাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এর মধ্যে সদর উপজেলার ৮ কিলোমিটার, গোয়ালন্দ উপজেলার ৬ কিলোমিটার, কালুখালী উপজেলার ৬ কিলোমিটার, পাংশা উপজেলার ৬ দশমিক ৬ কিলোমিটার ও বালিয়াকান্দি উপজেলার ৪ কিলোমিটার এলাকা রয়েছে। জেলা প্রশাসক জানান, চিঠি দেয়ার পরও বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙন হয়েছে। তবে তীব্রতা কম।

চিঠিতে বলা হয়েছে, নদীভাঙন ও বন্যার কারণে পাঁচ উপজেলার ১৩ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার প্রায় তিন হাজার, পাংশা উপজেলার হাবাসপুর ইউনিয়নের প্রায় এক হাজার, কালুখালী উপজেলার প্রায় ৩ হাজার ৫০০, গোয়ালন্দ উপজেলার প্রায় ৩ হাজার ৫০০ এবং বালিয়াকান্দি উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গড়াইয়ের ভাঙনে ২ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ১৪২ টন জিআর চাল বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা আরও চাহিদাপত্র দিচ্ছেন।
ড্রেজিংয়ের কারণে নদীভাঙন : জেলা প্রশাসকের চিঠিতে বলা হয়েছে, নদীতে পানি বৃদ্ধি ও ঘূর্ণন এবং ‘মোংলা থেকে চাঁদপুর-মাওয়া-গোয়ালন্দ হয়ে পাকশি পর্যন্ত নৌরুটের নাব্যতা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পাটুরিয়া থেকে পাকশি পর্যন্ত নৌরুটের চলমান ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রমের প্রভাবেও নদীভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে।

এ বছরের প্রথমার্ধে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ এ ড্রেজিং কাজ করে। কিন্তু নদীর মাঝখানে ড্রেজিং না করে রাজবাড়ী প্রান্তে নদী তীরবর্তী এলাকায় যেখানে নাব্য রয়েছে সেখানে ড্রেজিং করা হয়েছে।
বিষয়টি স্থানীয় জনসাধারণ, জনপ্রতিনিধি ও জেলা প্রশাসন থেকে নদীর মাঝামাঝি খনন করে খননকৃত মাটি বা বালি ভাঙনরোধে রাজবাড়ী প্রান্তে স্তূপ করার জন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানালেও কর্ণপাত করেনি।
১০০ বছরের বাঁধ ৮ বছরে ধ্বংস : চিঠিতে বলা হয়েছে, নদীভাঙন ঠেকাতে ৮ বছর আগে পানি উন্নয়ন বোর্ড যে বাঁধ নির্মাণ করেছিল, যার আয়ুষ্কাল গ্যারান্টি ছিল ১০০ বছর। মাত্র আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এ বাঁধটি ৮ বছরের মাথায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এক প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসক বলেন, বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম হয়েছে তা বলব না।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আমাকে জানিয়েছেন, বাঁধটি নির্মাণের সময়ে ভালোভাবে করা হয়েছিল, কিন্তু পানির অতি মাত্রায় ঘূর্ণনের কারণে বাঁধটি ভেঙে যাচ্ছে। আমরা জিও ব্যাগ ফেলাসহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছি। নদীভাঙন রোধে ব্যবস্থা নিতে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছেন বলেও জানান তিনি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/98529