৮ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ১০:২১

ঢাকায় ধর্মঘটে অচল পণ্য পরিবহন

সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনসহ ৭ দফা দাবি মালিক-শ্রমিকদেও * সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাংচুর * আন্দোলনে নামতে বাধ্য করার অভিযোগ * বিরুদ্ধে মাঠে নামছে শ্রমিক ফেডারেশন

ঢাকা ও আশপাশের জেলায় পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। ঢাকা বিভাগে রোববার সকাল থেকে শুরু হওয়া পরিবহন ধর্মঘটের কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সড়ক আইন সংশোধনসহ সাত দফা দাবিতে পণ্য পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ এ ধর্মঘটের ডাক দেয়।

সকাল থেকেই ঢাকায় পণ্যবাহী ট্রাক, লরিসহ এ জাতীয় গাড়ি ঢুকতে ও বেরোতে বাধা দেন ধর্মঘট সমর্থনকারীরা। কোথাও কোথাও সড়ক অবরোধ করে পরিবহন শ্রমিকদের বাধ্য করা হয় আন্দোলনে নামতে। এ সময়ে লাইসেন্সবিহীন চালকের মুখে ইঞ্জিনের পোড়া তেল মাখিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। ভাংচুর করা হয় যাত্রী ও পণ্যবাহী গাড়ি।
পণ্য পরিবহন বন্ধ থাকার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রাজধানীর পাইকারি বাজারগুলোতে। পরিবহন ধর্মঘট দীর্ঘ হলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করবে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এ ধর্মঘটের বিরুদ্ধে আজ থেকে মাঠে নামার কথা জানিয়েছে আরেক সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।

দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন পণ্য পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব মো. তাজুল ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, সড়ক আইন নিয়ে শ্রমিকদের চাপে এ কর্মসূচি দিয়েছি। আমাদের দাবি মেনে না নেয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। তিনি জানান, তাদের দাবির বিষয়ে রোববার রাত ৮টা পর্যন্ত সরকারের পক্ষে কেউ কোনো আশ্বাস দেয়নি, আলোচনায় বসার কথাও বলেনি।
ঐক্য পরিষদের দাবির মধ্যে রয়েছে- সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা গ্রহণ না করা, দুর্ঘটনায় চালকের দণ্ড ৫ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ হাজার টাকা ও জামিনযোগ্য ধারায় মামলার বিধান রেখে পরিবহন আইন সংশোধন করা। দাবিতে সমর্থন থাকলেও এ ধর্মঘটের সঙ্গে পরিবহন খাতের বেশ কয়েকটি সংগঠন একাত্মতা জানায়নি। উল্টো এ কর্মসূচির বিরোধিতা করেছে তারা। ধর্মঘটের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রোববার সন্ধ্যায় বৈঠক করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন।

বৈঠক শেষে ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী যুগান্তরকে বলেন, বিরোধীদের অর্থায়নে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে একটি অংশ পণ্য পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে, গাড়ি ভাংচুর করেছে। আমরা এ ধর্মঘট সমর্থন করি না। কাল (আজ) থেকে ধর্মঘটের নামে গাড়ি ভাংচুর করা হলে আমরা শ্রমিকদের নিয়ে মাঠে নামব, প্রতিবাদ জানাব। তিনি বলেন, সড়ক আইন সংশোধনসহ ৮ দফা দাবিতে আমরা ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করছি। ১১ অক্টোবর মানববন্ধন ও ১২ অক্টোবর ফেডারেশনের সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি মেনে নেয়া না হলে আমরাই সারা দেশে ধর্মঘট ডাকব।
এর আগে দুপুরে শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও নৌমন্ত্রী শাজাহান খান যুগান্তরকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার মামলা অজামিনযোগ্য ও ৫ লাখ টাকার জরিমানার বিধান নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।’ তবে এ ধর্মঘটে তার সমর্থন আছে কিনা- এ প্রশ্নে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
সরেজমিন দেখা গেছে, রোববার সকাল থেকে রাজধানীর তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনালে অবস্থান নেন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতারা। সেখানে শ্রমিকেরা ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিলও করেন। ব্যস্ত এ ট্রাক টার্মিনালে রোববার সব ট্রাক সাজানো অবস্থায় পার্ক করে রাখা হয়। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী-পোস্তগোলা সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন শ্রমিকরা। সেখানে শ্রমিকরা সড়কে চলাচল করা গাড়ি থামিয়ে চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করেন। যেসব চালকের লাইসেন্স নেই, তাদের নাকে-মুখে পোড়া ইঞ্জিন অয়েল মেখে দেন তারা। যাদের কাছে বৈধ লাইসেন্স পাওয়া গেছে তাদের গাড়ি চালানো বন্ধ করে আন্দোলনে নামার জন্য বলপ্রয়োগ করা হয়। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে রাস্তায় নেমে ধর্মঘটের সমর্থনে স্লোগান দেন শ্রমিকরা। তারা ঢাকায় পণ্যবাহী গাড়ি ঢুকতে বাধা দেন। গাড়ি থেকে শ্রমিকদের নামিয়ে আন্দোলন করতে বাধ্য করেন।
ধর্মঘটী চালকদের অভিযোগ, পথেঘাটে পুলিশ তাদের নির্যাতন করে। তাই আন্দোলন না করে আর কোনো পথ খোলা নেই। ট্রাকচালক আবুল কাশেম বলেন, অহেতুক পুলিশ মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। পুলিশের হাতে-পায়ে ধরেও মামলা থেকে বাঁচতে পারিনি। তার দাবি, এভাবে মামলার পর মামলা দিলে মালিকের আয় হবে না। চালকেরও চাকরি থাকবে না।

তার মতো অন্য চালকদেরও অভিযোগ, পুলিশ বাছ-বিচার ছাড়াই মামলা দিচ্ছে। নতুন করে তাদের মাথায় চেপেছে দুর্ঘটনায় ৫ বছরের সাজার বোঝা। আবদুল করিম নামের এক চালক বলেন, আইনে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। কারও কাছে পাঁচ লাখ টাকা থাকলে সে চালক হবে কেন? একজন চালক এক জীবনে পাঁচ লাখ টাকা আয় করতে পারেন না। এত জরিমানা দেবে কোথা থেকে?
ঢাকা-আশুলিয়া মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ : উত্তরা প্রতিনিধি জানান, উত্তরার ১০নং সেক্টরের কামারপাড়ায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন পরিবহন শ্রমিকরা। শ্রমিকরা শতাধিক কাভার্ড ভ্যান আটক করে সড়কের পাশে রাখেন। অবরোধের কারণে তীব্র যানজটে ভোগান্তির শিকার হন চলাচলকারীরা।

আন্দোলনকারী শ্রমিক নেতা আলাউদ্দিন যুগান্তরকে জানান, শাস্তি মওকুফ, সরকার ও পুলিশের নিত্যনতুন নিয়ম বন্ধসহ বিভিন্ন দাবিতে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, ধর্মঘট ডাকার পরও যেসব কাভার্ড ভ্যান সড়কে চলাচল করছে সেগুলো আটক করে মালিকদের জানানো হচ্ছে।
উত্তরা জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার কামরুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, ঢাকা-আশুলিয়া মহাসড়কের গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক করতে আন্দোলনকারীদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।

সাত দফা দাবির অন্যগুলো হচ্ছে : সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় টাঙ্গাইল জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সদস্য হাসমত আলীসহ যেসব মালিক ও শ্রমিক গ্রেফতার হয়েছেন তাদের মুক্তি দিতে হবে। সহজ শর্তে ভারি যানবাহন চালককে ভারি লাইসেন্স দিতে হবে। এর আগ পর্যন্ত হালকা বা মধ্যম লাইসেন্স দিয়ে ভারি যানবাহন চালানোর সুযোগ দিতে হবে।
সড়কে পুলিশের হয়রানি বন্ধ করতে হবে, গাড়ির কাগজপত্র চেকিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করা যেতে পারে। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ট্রাক টার্মিনাল বা স্ট্যান্ড নির্মাণ করতে হবে। গাড়ির মডেল বাতিল করতে হলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জরিমানা মওকুফ করে গাড়ির কাগজপত্র ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে। সারা দেশে গাড়ির ওভারলোডিং বন্ধ করতে হবে। ফুটপাত, ওভারব্রিজ, আন্ডারপাস ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/98522