৮ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ১০:১৯

দরপত্র শেষ করতে আড়াই বছর পার ব্যয় বাড়ছে ১৩০৭ কোটি টাকা

আন্তঃসীমান্ত সড়ক নেটওয়ার্ক

শ্লথ গতিতে চলছে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত প্রকল্পও। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্পটি ২০১৬ সালে অনুমোদন দেয়া হলেও প্রকল্পের কাজের দরপত্র ও নকশা চূড়ান্ত করতেই আড়াই বছর পার হয়েছে। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ হলো ছয় বছর দুই মাস। যার কারণে প্রকল্পে এখন বাড়তি কোনো অর্থ জাইকা দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। এখন প্রকল্প চালিয়ে নেয়ার জন্য জিওবি খাত থেকে ৫৩ শতাংশ বা এক হাজার ৩০৬ কোটি ৪৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আর গত দুই বছরের বেশি সময়ে প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৪ শতাংশ। দুই বছরে চারবার প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বদলি করা হয়েছে। পরামর্শক সেবা, যানবাহন কেনা, ভূমি অধিগ্রহণ খাতেই এই ব্যয় হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। নতুন করে ব্যয় বৃদ্ধিসহ সংশোধনী প্রস্তাব আগামী মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) তথ্যানুযায়ী, এশিয়ান হাইওয়ে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশীয়া অঞ্চলে অর্থনৈতিক নীতিমালার উদারীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে উচ্চ সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক জোন তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য দেশের পাঁচ জেলার সড়ক উন্নয়নে দুই হাজার ৪৭৩ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে একনেক সভায়। মূলত ভারতের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কের জন্য এই ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রভমেন্ট প্রকল্প বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। বলা হয়েছে, এশিয়ান হাইওয়ের বাংলাদেশ অংশের উন্নয়নের নিমিত্ত ১৭টি সেতু এবং সাতটি কালভার্ট নির্মাণ করা হবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। এর মধ্যে এশিয়ান হাইওয়ে-১ (ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-কালনা-যশোর- বেনাপল) মহাসড়কে পাঁচটি সেতু, একটি টোলপ্লাজা ও একটি এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন, এশিয়ান হাইওয়ে-৪১ (ঢাকা-কক্সবাজার) মহাসড়কে চারটি সেতু এবং এশিয়ান হাইওয়ে-৪১-এর সংযোগ (বারৈয়ারহাট- হেঁয়াকো-রামগড়) মহাসড়কে আটটি সেতু, সাতটি কালভার্ট ও একটি এক্সেল লোড কন্ট্রোল স্টেশন নির্মাণ করার কথা। আগামী ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার কথা।
আইএমইডির সরেজমিন প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণকাজ তদারকির জন্য ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রকল্পের জন্য পণ্য, কার্য ও সেবা ক্রয়ের জন্য মোট ১৯টি প্যাকেজ করা হয়। যার মধ্যে পণ্যে ১১টি, কার্য চারটি এবং সেবাতে চারটি প্যাকেজ। পরবর্তীতে নকশা, প্রাক্কলন ও দরপত্র দলিল প্রস্তুতকরণ শেষে পূর্ত কাজের মোট চারটি প্যাকেজের মধ্যে তিনটি প্যাকেজের টেন্ডার আহ্বান করা হয়। প্যাকেজ এ-১ এর দরপত্রের আর্থিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন সওজের প্রধান প্রকৌশলীর কাজে প্রেরণ করা হবে বলে দুই বছর পর জানানো হয়। প্যাকেজ এ-২ এবং এ-৩-এর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। যা গত মার্চে উন্মুক্ত করা হয়। আর প্যাকেজ বি-এর খসড়া টেন্ডার দলিল জাইকার সম্মতির (কনকারেন্স) জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। তবে ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান আছে। কিন্তু এই পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ৯৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

সওজের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নতুন কিছু কাজের অঙ্গ যুক্ত করার কারণে ব্যয় তিন হাজার ৭৯২ কোটি ৬০ লাখ ৬৭ হাজার টাকায় দাঁড়াবে। এখানে জাইকার টাকা অপরিবর্তিত থাকছে। কিন্তু জিওবির অংশ বৃদ্ধি পাবে। চার লেন সেতুগুলোতে ধীরগতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেন নির্মাণে অতিরিক্ত দু’টি লেনের প্রয়োজনীয়তা এবং এর জন্য বাড়তি ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব জাইকাকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়। জাইকা টেন্ডার দলিলের ওপর সম্মতি প্রদান করে। কিন্তু ঋণ চুক্তির অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করবে না বলে জাইকা জানিয়ে দিয়েছে। ফলে বাড়তি অর্থ জিওবি থেকে মেটাতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন কার্যক্রম দ্রুত করার জন্য প্রকল্প পরিচালককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় মহাসড়কের উভয় পাশে ধীরগতির যানবাহনের জন্য আলাদা লেনের সংস্থান রাখতে হবে। তাই প্যাকেজ এ-১, এ-২ এবং সি-এর আওতাধীন জাতীয় মহাসড়কে নির্মিতব্য সেতুগুলোর চার লেনের পাশে এই রাস্তা নির্মাণ করতে হবে। আর এই জন্য ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে।

প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জাইকার অর্থায়ন এক হাজার ৮৫১ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সরকারকে দিতে হবে ৬২১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ করার কথা। যশোর, নড়াইল, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলায় ১০টি উপজেলার সড়ক, সেতুর উন্নয়ন করতে হবে। সড়কগুলো আন্তর্জাতিক মানে করা হবে এই প্রকল্পের মাধ্যমে।
প্রকল্প প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে অর্থনৈতিক নীতিমালার উদারীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চ সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক জোন তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলের প্রায় ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন জনগোষ্ঠী তাদের আর্থসামাজিক সমৃদ্ধির ব্যাপারে আশাবাদী। দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে উন্নয়নের প্রবৃদ্ধিও এগিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে আন্তঃঅঞ্চলীয় বাণিজ্যের পরিমাণ এখনো আগের মতোই কম। এই কারণে আন্তঃঅঞ্চলীয় যোগাযোগ অক্ষুণœœ রাখতে সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং যথাযথ তত্ত্বাবধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের অবস্থান ভারত, নেপাল, মিয়ানমার এবং ভুটানের মাঝামাঝি হওয়ায় এই দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সূত্র বলছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রায় ৭০ শতাংশ সড়কপথ এবং এশিয়ান হাইওয়ের মতো আন্তর্জাতিক সড়কপথ বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। অথচ দেশের বিভিন্ন সেক্টরে বিশেষ করে কাস্টমস ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় অপর্যাপ্ত সুবিধা ব্যবস্থার কারণে অভ্যন্তরীণ এবং সীমান্ত এলাকার জরাজীর্ণ রাস্তা ও সেতুর দুরবস্থার জন্য আন্তর্জাতিক সড়কগুলোতে সঠিকভাবে চলাচল সম্ভব হয় না। সে জন্যই এই অঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে আঞ্চলিক ট্রানজিট যানবাহন চলাচলের পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থায়ী-অস্থায়ী অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আইএমইডি বলছে, প্রকল্পের আওতায় নির্মিতব্য কালনা সেতুর (প্যাকেজ এ-১) আহ্বানকৃত দরপত্রের মূল্যায়ন প্রতিবেদনের চূড়ান্ত অনুমোদন প্রক্রিয়াতে আছে। চলতি অর্থবছরই কার্যাদেশ প্রদানের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে বলে পিডি জানিয়েছেন। প্যাকেজ এ-২ ও সি-এর আর্থিক মূল্যায়ন এবং প্যাকেজ বি-এর কারিগরি মূল্যায়ন চলমান আছে। দুই বছরে চারজন পিডি পরিবর্তন করায় প্রকল্পের কাজে ব্যাঘাত হয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/355287