৮ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ১০:১২

সেন্ট মার্টিনস এবং সরকারের ব্যর্থতা

আশিকুল হামিদ : বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে মাঝেমধ্যেই কথা উঠে থাকে। এই সময়েও একই বিষয়ে নতুন পর্যায়ে সচেতন সকল মহলে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। এর কারণ সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার। এক বছরেরও আগে, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিমকে বাংলাদেশের ভেতরে ঠেলে পাঠানোর পর থেকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার বিরামহীন আহ্বানের প্রতি চরম উপেক্ষা দেখিয়ে মিয়ানমার আজও পর্যন্ত রোহিঙ্গাকেন্দ্রিক সংকটের সমাধান করার প্রশ্নে সামান্য ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি। মাত্র দিন কয়েক আগে, গত ২ অক্টোবর জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে একদিকে তিনি মিয়ানমারের প্রতি রোহিঙ্গাদের সসম্মানে ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, অন্যদিকে ভারতকে বলেছেন রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য। মহাসচিব বলেছেন, ভারতের উচিত মিয়ানমারের সঙ্গে তার সম্পর্কের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে এবং মানবিকসহ প্রয়োজনীয় সকল সহায়তা দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করার ব্যাপারে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো।

এমন এক অবস্থায় আশা করা হয়েছিল, ভারত এগিয়ে আসুক না আসুক, মিয়ানমার অন্তত জাতিসংঘ মহাসচিবের বক্তব্য ও আহ্বানকে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেবে এবং রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে সংকট সমাধানের পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটাবে। অন্যদিকে মিয়ানমার এগিয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে। রোহিঙ্গা সংকটের ধারেকাছে যাওয়ার পরিবর্তে দেশটি উল্টো এমন একটি ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশে কোনো দেশপ্রেমিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে দেশটির সঙ্গে এমনকি যুদ্ধও শুরু হয়ে যেতো। ইতিমধ্যে বহুল আলোচিত ওই পদক্ষেপ সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা যায়, মিয়ানমারের মানচিত্রে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ সেন্ট মার্টিনস দ্বীপকে মিয়ানমার তার নিজের এলাকা হিসেবে দেখিয়েছে। এর অর্থ বাংলাদেশের নয়, সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ মিয়ানমারের অংশ! দেশটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত মানচিত্রে বাংলাদেশকে সবুজ রঙের এবং মিয়ানমারকে আকাশি রঙের দেখানো হয়েছে। এতে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনসকে আকাশি রঙের অন্তর্ভুক্ত করে মিয়ানমার বোঝাতে চেয়েছে, সেন্ট মার্টিনস বাংলাদেশের অংশ নয়!

এই একটি বিষয়ে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, মিয়ানমারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হওয়ার পর প্রথম সুযোগেই গত ৬ অক্টোবর দেশটির রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমুদ্র বিষয়ক ইউনিটের প্রধান রাষ্ট্রদূতের হাতে প্রতিবাদপত্র তুলে দেয়ার পাশাপাশি বলেছেন, মিয়ানমারের এ ধরনের কাজ ধৃষ্টতাপূর্ণ এবং এর ফলে দু’ দেশের সম্পর্ক আরো তিক্ত হয়ে উঠবে। মিয়ানমার যাতে অবিলম্বে তার মানচিত্র সংশোধন করে এবং সেন্ট মার্টিনসকে বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দেখিয়ে নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেÑ সে বিষয়েও রাষ্ট্রদূতকে বলা হয়েছে। জানা গেছে, রাষ্ট্রদূত নাকি ‘ভুল’ স্বীকার করে সংশোধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মিয়ানমারের এ ধরনের ‘ভুল’কে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এর মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আরো একবার বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা ও ব্যর্থতাই প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কথাটা বলার কারণ, এর মাত্র ক’দিন আগে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা ও রাজ্যসভার প্রবীণ সদস্য সুব্রামনিয়াম স্বামীর বাংলাদেশ দখল করার হুমকি দিয়েছেন। বাংলাদেশ সংলগ্ন রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ তুলে বলেছেন, বাংলাদেশের হিন্দুদের নাকি জোর করে ধর্মান্তর করিয়ে মুসলিম বানানো হচ্ছে! একই সঙ্গে বাংলাদেশে নাকি হিন্দুদের ওপর প্রচন্ড দমন-নির্যাতন চালানোর পাশাপাশি অসংখ্য মন্দিরও দখল করা হচ্ছে! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন থাকলেও অবিলম্বে হিন্দু বিরোধী এসব কর্মকান্ড বন্ধ না করা হলে বাংলাদেশ দখল করার জন্য তিনি সরকারকে পরামর্শ দেবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন মিস্টার সুব্রামনিয়াম স্বামী। বলেছেন, বাংলাদেশকেই দখল করে নেবে ভারত। উল্লেখ্য, একই বিজেপি নেতা ২০১৪ সালে খুলনা থেকে সিলেট পর্যন্ত সমান্তরাল রেখা টেনে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ভ’খন্ড ভারতের দখলে নেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন।

সুব্রামনিয়াম স্বামীর আগে-পরে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ ও সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবসহ অন্য শীর্ষ নেতারাও কথিত অবৈধ বাংলাদেশি ধরনের নানা প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন। এখনো তাদের অবস্থান ও তৎপরতায় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কিন্তু রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বিরোধী এসব হুমকি ও বক্তব্যের কঠোর জবাব দেয়ার পরিবর্তে সরকারের পক্ষ থেকে প্রশ্নসাপেক্ষ নীরবতা পালন করা হয়েছে।

এরই পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রশ্নে সরকারের নীতি ও কার্যক্রমকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দরকার যেখানে ছিল আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি করার মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করা, সরকার সেখানে উল্টো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার নামে দেশের বিরাট একটি অঞ্চলের ভবিষ্যতকে চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। তুরস্ক ও ইরানসহ মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো বাংলাদেশের পক্ষে এগিয়ে এলেও এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলেও সরকার তাকিয়ে থেকেছে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের দিকে। অন্যদিকে বর্তমান সংকটের শুরু হওয়ার সময় থেকেই ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশকে শুধু নিরাশ করেনি, বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও গেছে। নিরস্ত্র ও নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর তথাকথিত শান্তিবাদী রাষ্ট্র মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যখন পরিকল্পিত গণহত্যার অভিযান শুরু করেছিল এবং জাতিসংঘসহ সারা বিশ্ব যখন দেশটির গণহত্যা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল তেমন এক জটিল সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদি মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন। ২০১৭ সালের আগস্টে সরকারি সফরে রাজধানী ইয়াঙ্গুনে যাওয়ার এবং মিয়ানমারের প্রধান নেত্রী অং সান সুচি ও সামরিক জান্তার নেতাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকের পর নেপিদোর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছিলেন, রাখাইন রাজ্যে ‘উগ্রপন্থী সহিংসতা’ নিয়ে মিয়ানমার সরকার যে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে তার সঙ্গে তিনি সহমত পোষণ করেন। মিস্টার মোদি এমনভাবে বক্তব্য রেখেছিলেন, যা শুনে মনে হয়েছে যেন কথিত মুসলিম উগ্রপন্থীরা সত্যিই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সহিংসতা চালাচ্ছে এবং এর ফলে সেনা সদস্যদের তো বটেই, সাধারণ মানুষের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়েছে!

বস্তুত প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রকারান্তরে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম বিরোধী হত্যা-নির্যাতন ও ধর্ষণসহ জাতিগত নির্মূল অভিযানের প্রতিই ভারতের সমর্থনের কথা জানিয়ে এসেছিলেন। তারপর অনেক সময় পার হয়েছে। কিন্তু ভারতের নীতি ও ভ’মিকায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়নি। এখনো যাচ্ছে না। সে জন্যই জাতিসংঘ মহাসচিবের অহ্বান ও পরামর্শ কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে আশা করা যায় না। উল্লেখ্য, দিল্লিতে দেয়া বক্তৃতায় মিস্টার অ্যন্টোনিও গুতেরেস বলেছেন, তিনি তার জীবনে রোহিঙ্গাদের মতো বৈষম্য ও নির্যাতনের অসহায় শিকার কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীকে দেখেননি। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার হিসেবে মিয়ানমার সফরকালে নিজের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে মহাসচিব বলেছেন, দেশটির বৌদ্ধ সমাজে বর্ণবাদ গভীরভাবে প্রোথিত। দেশটির সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মারাত্মক জাতিবিদ্বেষ রয়েছে। মহাসচিব নিজেও দেখেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রতি কতটা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা হয়। এক শ্রেণীর বৌদ্ধ ভিক্ষু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গা বিরোধী ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্য ছড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের পোড়ানো হয়েছে, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনীর নৃশংসতাও ছিল ভয়াবহ।

এসব কারণেই ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক প্রতিটি ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকের বিচার ও কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। মিস্টার গুতেরেস আরো বলেছেন, এ ধরনের বৈষম্যমূলক পরিস্থিতির মধ্যে বিশাল সংখ্যক মানুষকে ধরে রাখার অর্থ হলো পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে ঠেলে দেয়া এবং সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো। এমন অবস্থায় ভবিষ্যতের বহুপক্ষীয় বিশ্ব ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ হতে যাওয়া রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের উচিত মধ্যস্থতাকারীর গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা পালন করা। ভারত দুই প্রতিবেশি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ওপর নিজের প্রভাব খাটাতে পারে। ভারতকে বিশেষ করে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, দেশটি যাতে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়ে নেয় এবং তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

সন্দেহ নেই, জাতিসংঘের মহাসচিব রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে সঠিক ও বাস্তবসম্মত বক্তব্য রেখেছেন। এক শ্রেণীর উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুই যে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে প্রচারণা চালিয়ে রোহিঙ্গা বিরোধী হত্যা-নির্যাতনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং সাধারণ মানুষের পাশাপাশি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীও যে নির্যাতন ও গণহত্যা চালিয়েছেÑ এসব সত্যও মিস্টার গুতেরেসের বক্তব্যে যথোচিত গুরুত্ব পেয়েছে। বলা যায়, সব মিলিয়েই তিনি সত্যের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। হত্যা-নির্যাতন ও ধর্ষণসহ প্রতিটি অপরাধের জন্য দায়ী প্রত্যেকের বিচার ও কঠোর শাস্তির আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দায়ী সদস্য ও অফিসারদেরও বিচার করে শাস্তি দেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
এখানে বিশেষ করে ভারতের দিকে দৃষ্টি ফেরানো দরকার। কারণ, একদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব ভারতকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারও প্রধানত ভারতের ওপর ভরসা করেই মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের উদ্যোগে সাড়া দেয়নি। আর ভারত নিজেই যেহেতু প্রায় প্রত্যক্ষভাবে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করে চলেছে সেহেতু রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে তো বটেই, মিয়ানমার এমনকি বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ সেন্ট মার্টিনস দ্বীপকেও নিজেদের দখলে নেয়ার অপতৎপরতা শুরু করেছে। কথা শুধু সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের কারণে ওঠেনি। দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতিকদের বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিরোধী হুমকি ও বক্তব্যের কঠোর জবাব দেয়ার পরিবর্তে সরকারের পক্ষ থেকে তো প্রশ্নসাপেক্ষ নীরবতা অবলম্বন করা হচ্ছেই, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও জনগণকে নিরাশই করে চলেছে। ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে শুধু বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ভারতীয়দের প্রতিটি বক্তব্য ও উসকানির বিষয়ে দলটি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। সুব্রামনিয়াম স্বামীর বাংলাদেশ দখল করার হুমকির পরিপ্রেক্ষিতেও দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান ২ অক্টোবর এক বিবৃতিতে বলেছেন, সরকারের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণেই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। ভারতের আসামসহ বিভিন্ন রাজ্য থেকে অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করে মুসলিমদের বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানিয়েছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল। বলেছেন, এসব বিষয়ে সরকার রহস্যময় নীরবতা অবলম্বন করছে এবং কোনো কোনো বিষয়ে লুকোচুরি করছে। মূলকথায় তিনি বলেছেন, সবকিছুর মূলে রয়েছে সরকারের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি। প্রতিটি বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য ও ব্যাখ্যার দাবি জানিয়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, অন্যথায় জনগণ ধরে নেবে যে, সরকারও এই ষড়যন্ত্রে জড়িত রয়েছে।

লক্ষণীয় যে, ভারতীয়দের উসকানি ও হুমকির জবাবে সরকার তো বটেই, জামায়াত ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলও এখন পর্যন্ত কিছু বলেনি। দলগুলো কেবলই নির্বাচন এবং সরকারের পতন ঘটানোর জন্য ব্যস্ত রয়েছে। অথচ অন্য যে কোনো ইস্যুর চাইতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই বিশেষ করে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিরোধী বিভিন্ন প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং সুব্রামনিয়াম স্বামীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানো সকল রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রধান কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। সেটা করা হয়নি বলেই ভারতীয়দের দেখে সাহস বেড়ে গেছে মিয়ানমারের। দেশটি এখন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটিকেও গ্রাস করার ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গেই আবারও সরকারের পররাষ্ট্রনীতি প্রাধান্যে এসেছে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। পরারাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভালো। কারণ, বর্তমান সরকারের দশ বছরে জনগণ একথা বুঝতেই পারেনি যে, ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। বাস্তবে সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সকল বিচারেই সম্পূর্ণরূপে ভারতকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। জাতীয় স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করে হলেও প্রতিটি বিষয়ে সরকার কেবল ভারতের ইচ্ছাই পূরণ করেছে- যার সর্বশেষ প্রমাণ হিসেবে এসেছে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ভারতকে ব্যবহার করতে দেয়ার চুক্তি। চুক্তিটি যে কোনো সময় স্বাক্ষরিত হবে। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়েও সরকার জনগণকে জানতে দেয়নি। জাতীয় সংসদে চুক্তিটি নিয়ে কোনো আলোচনা পর্যন্ত করা হয়নি।

অথচ দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া যে কোনো সরকারের প্রধান দায়িত্ব। বাংলাদেশকে দখল করার যে হুমকি দেয়া হয়েছে সে হুমকিসহ ভারতীয়দের বাংলাদেশ বিরোধী সকল বক্তব্য ও তৎপরতার বিরুদ্ধে তো বটেই, মিয়ানমারের ধৃষ্টতাপূর্ণ পদক্ষেপের বিরুদ্ধেও সরকারকে দেশপ্রেমিক ভূমিকা পালন করতে হবে। এসব বিষয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সোচ্চার হওয়া প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও জোটেরও কর্তব্য। আমরা সে আহ্বানই জানাই।

http://www.dailysangram.com/post/348493