৭ অক্টোবর ২০১৮, রবিবার, ১০:০৯

দু'পাড়ে ২১৮১ অবৈধ স্থাপনা

বিপর্যস্ত কর্ণফুলী

হাইকোর্টের নির্দেশ থাকার পরও কর্ণফুলীর ফিশারিঘাট এলাকায় গড়ে ওঠা এসব অবৈধ স্থাপনা গত দুই বছরেও উচ্ছেদ হয়নি -মো. রাশেদ
কর্ণফুলীর সঙ্গে লাগোয়া রাজাখালী খাল। সেই খালের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া সড়কের একপাশে কলোনি করে অর্ধশত নতুন ঘর তুলেছেন জাহাঙ্গীর সওদাগর, রফিক সওদাগর, নসু মাঝি ও মনির মাঝি নামের চার ব্যক্তি। রাস্তার অপর পাশে একইভাবে ভাড়ার জন্য নতুন ঘর তুলছেন নোয়াব খান, আজিজ খান ও ইউসুফ খান নামের তিন ভাই।

আবার কর্ণফুলীর তীর অবৈধভাবে দখল করে দিব্যি ব্যবসা করছে সোনা মিয়া ডকইয়ার্ড, হাজি আবদুল গণি ডকইয়ার্ড, রশিদ অ্যান্ড কোং, কাপ্তাই বোট বিল্ডার্স, নূসরাত জাহান ডকইয়ার্ডসহ সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠান। জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী এ সংখ্যা দুই হাজার ১৮১। এসব অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করে চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলীকে রক্ষা করতে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। কিন্তু দুই বছর পার হলেও উচ্ছেদ হয়নি একটি স্থাপনাও। উল্টো কর্ণফুলীর পাশাপাশি এখন তার শাখা নদীগুলোতেও নতুন করে উঠছে একের পর এক অবৈধ স্থাপনা। দখল-দূষণে প্রতিনিয়ত রূপ হারাচ্ছে কর্ণফুলী। যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও সচেতনতার অভাবেই নদীটি এখন বিপর্যস্ত।

পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলীর দৈর্ঘ্য ১৩১ কিলোমিটার। এ ছাড়া ৮৮ কিলোমিটারের হালদা নদী, ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ইছামতী নদী এবং ২৯৫ কিলোমিটারের সাঙ্গু নদী রয়েছে চট্টগ্রামে। কর্ণফুলীর মতো দখল ও দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে আছে সব নদীই।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ইলিয়াছ হোসেন বলেন, 'আমরা কর্ণফুলী তীরের অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করেছি। তাদের উচ্ছেদের জন্য কর্মপন্থাও নির্ধারণ করেছি। অবৈধ দখলদারদের নোটিশ দিয়েছি। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছি। কিন্তু উচ্ছেদের জন্য যে অর্থ দরকার, সংশ্নিষ্ট দপ্তর থেকে সেটি এখনও পাইনি। একাধিকবার এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে।'

চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে ২০১০ সালের জুলাই মাসে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন হাইকোর্টে রিট করে। এ রিটের পরিপ্রেক্ষিতে কর্ণফুলী নদী দখল, মাটি ভরাট ও নদীতে যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে নদীর প্রকৃত সীমানা নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও নির্দেশ দেন আদালত। জরিপ করে নদীর দুই তীরে দুই হাজার ১৮১ অবৈধ স্থাপনা আছে বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন। জরিপ প্রতিবেদনটি গত বছরের ৯ জুন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার ও অ্যাটর্নি জেনারেলের মাধ্যমে হাইকোর্টে দাখিল করে জেলা প্রশাসন। এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি কাশেফা হোসেনের ডিভিশন বেঞ্চ সব স্থাপনা উচ্ছেদে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দেন। এ সময়সীমা শেষ হয়ে গেলেও অবৈধ স্থাপনার একটিও উচ্ছেদ হয়নি। উল্টো নদীতীরে রাতারাতি উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা। অথচ নদীকে সুরক্ষিত রাখতে সরকারও গঠন করেছিল বিশেষ টাস্কফোর্স। এ কমিটিকে দেওয়া হয়েছিল সর্বময় ক্ষমতাও। তারপরও রক্ষা হচ্ছে না চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলী।
এদিকে, কর্ণফুলীর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় গত ২০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত নদী কমিশনের এক বৈঠকে বিস্ময় প্রকাশ করেন জাতীয় নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার।

শুধু কর্ণফুলী নয়, চট্টগ্রামের হালদা, সাঙ্গু, ডাকাতিয়া, মেঘনা নদীর অবস্থাও দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত হয়ে আছে। চট্টগ্রাম বিভাগের প্রধান নদীসহ ৪৮ নদ-নদীকে রক্ষা করতে এগুলোর বর্তমান অবস্থা, আয়তন, অবৈধ দখলদারের সংখ্যা, পানির দূষণমাত্রাসহ নানা বিষয় জানতে ১১ জেলা প্রশাসককে (ডিসি) মাস ছয়েক আগে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অফিস। চট্টগ্রামসহ কক্সবাজার, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর জেলা প্রশাসকের কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত ও তাদের উচ্ছেদকরণ, নাব্য বজায় রাখতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি খনন প্রস্তাবনা পাঠাতে বলা হয়েছে। চিঠির উত্তর পাওয়ার পর সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার্বিক বিষয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে পাঠানোর কথা। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই এই উদ্যোগেও। প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে কুমিল্লায় ১৬টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৪টি, চট্টগ্রামে পাঁচটি, খাগড়াছড়িতে চারটি রাঙামাটিতে তিনটি, বান্দরবানে তিনটি, নোয়াখালীতে দুটি ও কক্সবাজারে একটি নদ-নদী রয়েছে।

http://samakal.com/whole-country/article/1810388