৬ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ১১:৫২

সরকারি পরিপত্র-নির্দেশনা মানছে না মন্ত্রণালয়গুলো

সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই প্রকল্প প্রস্তাবনা

মন্ত্রণালয়গুলো উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারি পরিপত্র বা নির্দেশনা মানছে না। ২৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে প্রাক্কলিত ব্যয়সম্পন্ন সব বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণের আগে বাধ্যতামূলক সম্ভ্যাব্যতা যাচাই করার সরকারি বিধান রয়েছে। কিন্তু সেই বিধান পালন না করে কোনো ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই বা জরিপ ছাড়াই শুধু ইন হাউজ স্ট্যাডি করেই প্রকল্প প্রস্তাবনা দেয়া হচ্ছে অনুমোদনের জন্য। শত কোটি টাকা থেকে হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে এ ধরনের বাধ্যবাধকতা তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। আবার প্রত্যেক বিনিয়োগ প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছরে সীমাবদ্ধ রাখার বিধানও লঙ্ঘিত হচ্ছে অহরহ। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে এমনই দু’টি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য দেয়া হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি নিয়ে সরকারের জারিকৃত পরিপত্রের ৪.১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ২৫ কোটি টাকার বেশি প্রাক্কলিত ব্যয়সম্পন্ন সব বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণের আগে আবশ্যিকভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। আর ৪.২ অনুযায়ী, বাস্তবায়নকারী সংস্থা জরিপ বা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প প্রস্তাব জরিপ বা সমীক্ষা ছকে প্রণয়ন করবে। ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রাক্কলিত ব্যয়ের জরিপ বা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্প বিভাগীয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশক্রমে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী অনুমোদন করবেন। পাঁচ কোটি টাকার বেশি প্রাক্কলিত ব্যয় হলে তা প্রক্রিয়াগতভাবে হয়ে পরিকল্পনা কমিশনের মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী অনুমোদন দেবেন। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দু’টি প্রস্তাবিত প্রকল্প পর্যালোচনায় সরকারি নির্দেশনা পালন না করার বিষয়টি প্রকাশ করেছে খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি)।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্বাচিত ৯টি সরকারি কলেজের উন্নয়নের জন্য ৩৬৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্প দেয়া হয়েছে। তিন বছরের এ প্রকল্পটি তৈরির জন্য কোনো ধরনের সমীক্ষা বা সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। চাহিদার ভিত্তিতে কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেহেতু ২৫ কোটি টাকার বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন খরচ, তাই মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন ও তথ্য যাচাই করে সব চাহিদা নিরূপণ করে আলাদা মাস্টার প্ল্যান করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি ক্রয় পরিকল্পনায় একাধিক ক্রয়পদ্ধতি উল্লেখ করাকে পরিহার করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পিপিআর অনুযায়ী ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণ ব্যয় গণপূর্ত রেইট শিডিউল-২০১৮ অনুসরণে প্রাক্কলন করতে বলা হয়েছে।
অন্য দিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জরাজীর্ণ ও অপ্রশস্ত ৬৩টি বেইলি সেতু সংস্কারের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২০ কোটি ৯৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। তিন বছরের এ প্রকল্পের জন্যও পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করা হয়নি বলে পরিকল্পনা কমিশনের পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। ঢাকা জোনের আওতায় কতটি সেতু কী অবস্থায় আছে এবং সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি এখনই প্রতিস্থাপনযোগ্য সে বিষয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় কোনো আলোকপাত করা হয়নি। ঢাকা জোনের চারটি বেইলি সেতুর মধ্যে দু’টি সেতু প্রস্তাবিত প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাকি দু’টি সেতু কেন অন্তর্ভুক্ত হয়নি সে বিষয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। কাজেই সমীক্ষাটি পূর্ণাঙ্গ নয়। এ কারণে একটি পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করতে হবে; যাতে সেতুগুলোর সার্বিক অবস্থা জেনে সে অনুযায়ী প্রকল্প নেয়া যায়।

এর আগে চলমান বেশ কিছু প্রকল্পও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই করা হয়েছে। পরে আবার একনেকের চাপে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়েছে। যেমনÑ ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ইউপি ও পৌরসভায় দক্ষতা উন্ন্রয়ন প্রকল্প, ১৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে বাকেরগঞ্জ-বরগুনা ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইন এবং বরগুনা ১৩২/৩৩ কেভি উপকেন্দ্র নির্মাণ, হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে স্মার্টকার্ড প্রকল্প, তিন হাজার ৮২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ইভিএম সংগ্রহ প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প।
অন্য দিকে পরিপত্রের ১.১.৮ অনুযায়ী বিশেষ প্রকল্প ছাড়া সব প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল তিন বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। কিন্তু কোনো প্রকল্পই নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন হচ্ছে না। কোনোভাবে অনুমোদন করা গেলে জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি, রেইট শিডিউল পরিবর্তন, নতুন করে খাত যুক্ত করা, ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা ইত্যাদির কারণ দেখিয়ে দফায় দফায় প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে বাস্তবায়ন খরচ। সড়ক, অবকাঠামো, রেল, পানিসম্পদ, শিক্ষা সব খাতের প্রকল্পেরই একই দশা। এডিপি পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছর জুনে সমাপ্ত হওয়ার কথা ছিল এমন প্রকল্পের ওপর সম্প্রতি এক পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাদারীপুর ভায়া কাজিরটেক ব্রিজ থেকে শরীয়তপুর সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার কাজ ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়। ১৯১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ের এ সড়কের কাজ ২০১৩ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু আড়াই বছর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ে আরো ৫ বছর। ৯ বছর ধরে চলছে কক্সবাজার বিমানবন্দর নির্মাণকাজ। এটিকে এখন ১১ বছরে টেনে নেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

আবার বাংলাদেশ রেলওয়ের সিগন্যালিংসহ টঙ্গী-ভৈরববাজার সেকশনে ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পটি এক যুগ ধরে চলছে। ব্যয় ৭২৪ কোটি টাকা থেকে এখন দুই হাজার ১৭৫ কোটি ৯০ লাখ টাকায় পৌঁছেছে। প্রকল্পটি ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে একনেক থেকে অনুমোদিত হয়। বলা হয়েছিল ২০১১ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত করা হবে। কিন্তু সেটি করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। ২০১৪ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী আবারো সময় বাড়িয়ে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়নকাল নেয়া হয়। এরপর দু’বার ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াও মেয়াদ বাড়ানো হয়। একবার ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত এবং পরের বার ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত।

পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক কর্মকর্তারা ও পিইসি সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতির পরিপত্র অনুযায়ী প্রক্রিয়া করা হয় না। প্রকল্পের অনুমোদনের ক্ষেত্রে যখন প্রস্তাবনা কমিশনের কাছে পাঠানো হয়, তখন অনেক প্রস্তাবনাই পরিপত্র আলোকে হয় না। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে বাধ্য হয়ে প্রকল্পগুলোকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদের সাথে আলাপকালে তিনি জানান, অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমেই দুর্নীতি ও অনিয়ম বেশি হয়। এটি হলো কয়েকটি বিভাগের বড় ব্যবসা। প্রকল্প শুরু হচ্ছে কিন্তু কখনো শেষ হচ্ছে না। মাঠপর্যায়ে দেখা যাবে অনেক সড়ক ও সেতুর কাজ শুরু করা হয়েছিল, কিন্তু তা আর সমাপ্ত হয়নি।

http://www.dailynayadiganta.com/first-page/354797