ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-ছবি সংগৃহীত
৬ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ১১:৪৮

পুলিশের নিয়ন্ত্রণ স্বাধীন প্রেসের মৃত্যু ডেকে আনবে

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ অস্বীকার করার জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইন সাংবাদিকতার পেশাকে পুলিশের নজরদারিতে ঠেলে দেবে যা হবে সাংবাদিকদের জন্য চরম অপমানজনক। সাংবাদিকদের কম্পিউটার ইত্যাদি জব্দ করে নিয়ে যেতে পারবে পুলিশ। এ ক্ষেত্রে যে জঘন্য ব্যাপারটি ঘটবে তা হল, সাংবাদিকতানির্ভর করবে পুলিশের খেয়ালখুশির ওপর এবং গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় কর্তৃত্ব অকার্যকর হবে।
সরকার প্রথমে প্রণয়ন করে বিতর্কিত আইসিটি আইন। এখন সরকার প্রবর্তন করছে ভয়ংকর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সাংবাদিকরা বলছেন, আইসিটি আইনের ৫৭ অনুচ্ছেদ ভিন্নভাবে বহাল করতে যাচ্ছে সরকার। আসলে সরকার সাংবাদিকদের আতঙ্কের মধ্যে রাখতেই এ ধরনের আইন করতে চেয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ৫৭ ধারায় গণমাধ্যমের সাত শতাধিক বেশি কর্মীর বিরুদ্ধে করা মামলা ইতিমধ্যে বিচারাধীন রয়েছে।

রাজনীতির ক্ষেত্রেও সরকার শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ভীষণ হয়রানির মধ্যে রেখেছে। দেশটি এখনও পুলিশি রাষ্ট্র না হলেও সরকার ব্যাপকভাবে পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ করাটা যে রাজনীতির চর্চা নয়, এটি বোঝানো যাচ্ছে না এবং এ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের কোনো উদ্বেগও নেই।
প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ব্যাপক পরিমাণ অপরাধকে উদ্ভটভাবে অন্তর্ভুক্ত করে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে কোর্টের নির্দেশ ছাড়াই যে কোনো ব্যক্তিকে, যে কোনো স্থানে এবং যে কোনো সময় তল্লাশি ও গ্রেফতার করার। তদন্তের নামে তার কম্পিউটার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ পুলিশ তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে শাসনতন্ত্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলোর কোনো রক্ষাকবচ বা বিচারিক প্রক্রিয়ার গুরুত্ব থাকছে না। পুলিশকে অবশ্যই মান্য করতে হবে। তাকে দোষারোপ করা যাবে না। কারণ এটাই আইন।
স্বাধীন দেশের মুক্ত মানুষের জন্য কোনো ধরনের স্বাধীনতা সম্পর্কে যদি কারও উদ্বেগ থেকে থাকে, তবে তিনি আলোচ্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিকে আইনের পাগলামি হিসেবেই দেখবেন।
এ কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, জাতি হিসেবে আমরা যে স্বার্থপর এবং ভীতু, সরকার এ ব্যাপারে স্থির নিশ্চিত হয়ে তার নিজের জন্য পথ খুঁজে নিয়েছে। নির্বাচিত না হয়েও সরকার গঠন করা যায় এবং জনগণের ওপর তাদের শাসন চাপিয়ে দেয়া যায়- এ উপলব্ধিতে পৌঁছেছে বর্তমান সরকার। বিনা ভোটে আমলাদের সাজানো নির্বাচনী বিজয় ঘোষণা দিয়ে সরকার গঠন সম্ভব হয়েছে বলেই আইন আর শাসনতন্ত্র নিয়ে সরকার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ দেখে না। জনগণের মুক্তির ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কোনো উদ্বেগ দেখা যাচ্ছে না।

সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর আগে যখন একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অস্বীকার করা হয়, তখনও সাংবাদিকরা দলবেঁধে বাকশালে যোগ দিয়ে নিজেদের জন্য অত্যন্ত অশুভ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
এ নতুন আইনের ৪৩ ধারায় পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতার করার কথা বলা হয়েছে। ১. যদি কোনো পুলিশ কর্মকর্তার এরূপ বিশ্বাস করার কারণ থাকে যে কোনো স্থানে এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে বা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বা সাক্ষ্য-প্রমাণাদি হারানো, নষ্ট হওয়া, মুছে ফেলা, পরিবর্তন বা অন্য কোনো উপায়ে দুষ্প্রাপ্য হওয়ার বা করার সম্ভাবনা রয়েছে, তাহলে তিনি অনুরূপ বিশ্বাসের কারণ লিপিবদ্ধ করে নিুবর্ণিত কার্য সম্পাদন করতে পারবেন :
ক. উক্ত স্থানে প্রবেশ করে তল্লাশি এবং প্রবেশে বাধাপ্রাপ্ত হলে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ;
খ. উক্ত স্থানে তল্লাশিকালে প্রাপ্ত অপরাধ সংঘটনে ব্যবহার্য কম্পিউটার, কম্পিউটার সিস্টেম, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, তথ্য-উপাত্ত বা অন্যান্য সরঞ্জামাদি এবং অপরাধ প্রমাণে সহায়ক কোনো দলিল জব্দকরণ;
গ. উক্ত স্থানে উপস্থিত যে কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাশি;
ঘ. উক্ত স্থানে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করেছেন বা করছেন বলে সন্দেহ হলে উক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার।

১৭ সেপ্টেম্বর এ আইনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করার সময় ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটি যে সুপারিশ পেশ করেছিল সেখানে বলা হয়েছিল আইনের আলোচ্য ধারায় কাউকে গ্রেফতার করতে হলে নতুন এ আইনের অধীনে গঠিতব্য ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালকের কাছ থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
কিন্তু বিলটি সংসদে পাস করার সময় জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম মহাপরিচালকের কাছ থেকে অনুমোদন নেয়ার বিধান বাদ দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করতে গিয়ে বলেন, এ শর্ত আইন প্রয়োগকারীদের কর্তব্য পালনে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। তখন জাতীয় সংসদে বিলটির উত্থাপনকারী ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সংশোধনী প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়ে যায়।
সম্পাদক পরিষদ অসহায়ভাবে এ কালো আইনের বিরোধিতা করে যাচ্ছে। সরকার এ বিশ্বাসে অটল রয়েছে, সাংবাদিকরা বিভক্ত এবং নৈতিকভাবে দুর্বল। তাদের ভেতরের একটি বড় অংশ সরকারের রাজনৈতিক সমর্থক-কর্মী। তাই সরকার এ ব্যাপারে নিশ্চিত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যতই কালো আইন হোক না কেন, সাংবাদিকদের সমর্থন পাবেই।

সচেতন সাংবাদিক সমাজ হচ্ছে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ, তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে পুলিশ কর্মকর্তারা আর তার বিরুদ্ধে সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করবে না, এ কথা কি কোনো গণতন্ত্রমনা সরকার ভাবতে পারে? বিশ্বাস হয় না। একজন প্রধান বিচারপতি তার বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের প্রমাণ ছাড়াই যেভাবে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন; তাতেই ফুটে ওঠে সরকারের অসহিষ্ণু ও নিরপেক্ষ বিচারের প্রশ্ন।
সমগ্র বিচার বিভাগকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের কী পরিণতি হতে পারে। আমরা বিচার বিভাগকে শক্তি জোগাতে পারিনি। তবুও বিচারপতি হিসেবে সাহস তাদের দেখাতেই হবে। শাসনতন্ত্র তাই বলে। সাংবাদিক সমাজ ও বিচারপতিরা মানুষের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে তাই বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।
একইভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে সাংবাদিক সমাজকেই; এ স্বাধীনতা রক্ষা করেই তারা শাসনতন্ত্র স্বীকৃত সবধরনের স্বাধীনতাকে সংরক্ষিত করে থাকেন। সব স্বাধীনতার জননী হচ্ছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। তাই সাংবাদিকদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও আস্থার গুরুত্ব, গভীরতা ও পবিত্রতা অপরিসীম।

আমলাতান্ত্রিক প্রভাব বলয়ে থেকে সরকার যখন পুলিশি রাষ্ট্র চালাতে চাইছে, তখন সরকার সেভাবে চলুক। কিন্তু গণমাধ্যম একটা ভিন্ন জগৎ, গণমাধ্যম পুলিশ নিয়ন্ত্রিত হোক এটি সাংবাদিক সমাজ মেনে নিতে পারে না। পুলিশি রাষ্ট্রের ধারণায় সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কোনো স্থান নেই, এটি বুঝেই সাংবাদিকদের নিজেদের দায়িত্ব ও মর্যাদার কথা ভাবতে হবে।
আমাদের প্রেস কাউন্সিল রয়েছে এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পুলিশি কার্যক্রম শুরু করার আগে প্রেস কাউন্সিলের অনুমতি নিতে হবে। সত্যিকারের সাংবাদিক সমাজ পুলিশ বা আমলা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা মানতে পারে না। দেশ শুধু আমলাদের নয়, সাংবাদিকদেরও। জনস্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে সাংবাদিকদের বিশ্বাসে নিতেই হবে। এ দাবিতে সাংবাদিকদের অটল থাকতে হবে। আইনের আওতায় গঠিত প্রেস কাউন্সিলই সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের বৈধ সংস্থা। পুলিশি নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সাংবাদিকদের অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
জনগণের স্বাধীন ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে গণমাধ্যম থাকবে নতুবা থাকবে না। ধোঁকাবাজির সহায়ক না হওয়াই হবে সাংবাদিকদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ। আরও পরিষ্কার করে বলতে হলে বলতে হয়, সরকার তাদের কালো আইন নিয়ে ব্যস্ত থাকুক, সাংবাদিকরা তাদের সাংবাদিকতার শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করে যাবে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/97729