৫ অক্টোবর ২০১৮, শুক্রবার, ১১:০২

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ

সচেতন হওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজধানী ঢাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, তবে দেশের অন্যত্র স্বাভাবিক। চলতি বছরের শুরু থেকে গত বুধবার পর্যন্ত ৬ হাজার ৪২৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ঢাকার বাইরে মাত্র ৪ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত তিন দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ১৭৯ জন। গত বছর জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ২৩৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত বছর চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতিও মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। তবে এবার চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ স্বাভাবিক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গৃহীত পদক্ষেপ ও সিটি করপোরেশনের মশক নিধন কার্যক্রমের পরও ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে না। মশক নিধন করে ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারাও অস্বস্তিকর অবস্থায় রয়েছেন। তবে সংশ্নিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের কাজের সমন্বয়হীনতা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বর মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৭৪ জন আক্রান্ত এবং ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর পরই আগস্ট মাসে এক হাজার ৭৯৬ জন আক্রান্ত এবং সর্বোচ্চ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর পর জুলাই মাসে আক্রান্ত হন ৯৪৬ জন এবং মৃত্যু হয় ৪ জনের। জুন মাসে ২৯৫ জন আক্রান্ত এবং ৩ জনের মৃত্যু। অক্টোবরের মাত্র তিন দিনেই ১৭৯ জন আক্রান্ত হয়েছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগে ৩ জন ও খুলনা বিভাগে মাত্র ১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। তবে তারা চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

গত বুধবার পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন সবেচেয়ে বেশি লোক; ৮৪৪ জন। এখানে এখনও ৫৫ জন চিকিৎসাধীন। এর পরই ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭০৩ জন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৬৮ জন, মুগদা হাসপাতালে ৫২২ জন, মিটফোর্ডে ৪২০ জন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৩২০ জন, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৩১৮ জন, ইউনাইটেড হাসপাতালে ২৯৬ জন, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ২৯৫ জন, ইবনে সিনায় ২৮৮ জন, ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ২৭২ জন, সালাউদ্দিন হাসপাতালে ২৬৩ জন, বারডেম হাসপাতালে ২৪৮ জন, স্কয়ার হাসপাতালে ২৪৬ জন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২৫ জন আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়া ২৫৪ জন রাজধানীর অন্যান্য হাসপাতালে চিকিসাধীন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসে করা জরিপে রাজধানীর উত্তর সিটি করপোরেশনে এডিস মশার ঘনত্ব ছিল ২৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে এ হার ছিল ৩২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। কিন্তু জুলাই মাসে তা ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের গুলশান-১ নম্বরে এডিস মশার ঘনত্ব ঝুঁকিমাত্রা ছিল ৭০ শতাংশ। এর পরই মিরপুর ১১ নম্বরে ৬০ শতাংশ। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মণিপুরিপাড়া, নিকেতন. গাবতলী ও লালমাটিয়ায় এই হার ৪০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এডিস মশার ঘনত্ব ঝুঁকির সহনীয় মাত্রা ২০ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া) ডা. এমএম আক্তারুজ্জামান সমকালকে বলেন, জরিপে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৫ এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪২ ওয়ার্ডে এডিস মশার প্রজনন ও বিস্তারের নমুনা ও লক্ষণ পাওয়া যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক ভবন, বাণিজ্যিক এলাকার পাশাপাশি নির্মাণাধীন বাড়ির ছাদ, পরিত্যক্ত পরিবহন, টায়ার, প্লাস্টিক ড্রাম, বালতি, ফুলের টব, স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে এডিশ মশার প্রজনন ও বংশবিস্তার বেশি দেখা গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, রাজধানীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ ও ভয়াবহতা দুটিই বেড়েছে। হিসাব থেকেই তা পরিস্কার। গত বছরের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যু- দুটিই বেড়েছে। আগে শুধু ডেঙ্গু-১ এবং ডেঙ্গু-২-এ মানুষ আক্রান্ত হলেও চলতি বছর ডেঙ্গু-৩-এ আক্রান্ত রোগীও পাওয়া যাচ্ছে।

ডা. আব্দুল্লাহ আরও বলেন, চার ধরনের ডেঙ্গুর মধ্যে ডেঙ্গু-১ ও ডেঙ্গু-২-এ মৃত্যুঝুঁকি নেই। কয়েক দিন চিকিৎসা নিলেই আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হতে পারেন। কিন্তু ডেঙ্গু-৩-এ মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। চলতি বছর অনেকে ডেঙ্গু-৩-এ আক্রান্ত। তবে ডেঙ্গু-৪-এ আক্রান্ত রোগী এখনও পাওয়া যায়নি।

শিশুরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছে ৩১৮ শিশু। তাদের মধ্যে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালের এপিডেমিওলজিস্ট কিংকর ঘোষ সমকালকে বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুর বেশিরভাগের বয়স ১০ বছরের নিচে। একদিনে সর্বোচ্চ ৫৯ শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইসিডিআর) জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ডা. এএসএম আলমগীর সমকালকে বলেন, ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। ডেঙ্গু জীবাণুবাহী মশার কামড়ের পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়। কিছু ডেঙ্গু রোগী কোনো উপসর্গ ছাড়াই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। তবে ডেঙ্গু হলে জ্বর, মাথাব্যথা, পেশী ও গিটে ব্যথা এবং ত্বকে র্যা শ ওঠে। খুব কম ক্ষেত্রে এটি প্রাণঘাতী ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বরে পরিণত হয়। এটি হলে রক্তপাত হয় এবং রক্ত অণুচক্রিকার মাত্রা কমে যায়। পরবর্তীকালে ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোমে পরিণত হয়।

ডা. আলমগীর বলেন, প্রতি বছর জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু বিস্তারের আশঙ্কা থাকে। জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই সময়ে ডেঙ্গু মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণকেও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

http://samakal.com/bangladesh/article/1810268