৫ অক্টোবর ২০১৮, শুক্রবার, ১১:০১

তবু প্রাণঘাতী ঢাকার সড়ক

বেসরকারি পরিবহন মালিক ও চালকদের অসহযোগিতায় শৃঙ্খলা ফেরেনি সড়কে

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর প্রায় দুই মাসে নিরাপদ সড়কের জন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও বেসরকারি পরিবহন মালিক ও চালকদের অসহযোগিতায় সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। ফলে থামেনি সড়কে মৃত্যুর মিছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ২১ জনের। তাদের মধ্যে ১১ জনই পথচারী, সাতজন ছিল মোটরসাইকেল আরোহী।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে খুদে শিক্ষার্থীদের সাড়া জাগানো আন্দোলন হয় গত ২৯ জুলাই থেকে। পরে সরকারের আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা ঘরে ফেরে। শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে এবং সড়ক নিরাপদ করতে গত আগস্ট থেকে ব্যাপক উদ্যোগ নেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং এসব মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তর। একের পর এক সভা, সড়কে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ থেকে শুরু করে বাস বে নির্মাণ, জেব্রাক্রসিং ও ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা, ১২১টি বাস স্টপেজ চিহ্নিত করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাস মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান তেমন অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। প্রতিযোগিতা করে দ্রুতগতিতে বাস চালিয়ে যেখানে-সেখানে থামিয়ে যাত্রী তোলা হচ্ছে। চিহ্নিত করা বাস স্টপেজ ব্যবহার করা হচ্ছে না।

ঢাকার সড়কে নানা অনিয়মের কারণে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে দুই লাখ ৫২ হাজার ৯৭৮টি মামলা করা হয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে ১৬ কোটি ৫৭ লাখ ৬২ হাজার ৪৫৯ টাকা।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে, রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মানুষের ৫১ শতাংশই পথচারী। রাজধানীতে পথচারীদের রাস্তা পারাপারের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় পথচারীদের প্রাণহানির প্রবণতা আগের মতোই আছে বলে জানান গবেষকরা।
গত কয়েক দিন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফুটপাত না থাকায় মিরপুর, আগারগাঁও, কমলাপুর, শাহজাহানপুর, পল্টনসহ বিভিন্ন স্থানে পথচারীদের রাস্তায় নেমে হাঁটতে হয়। রাস্তা পার হতে গিয়ে দৌড় দিতে হয়। আর তখনই বেপরোয়া বাস বা মোটরসাইকেলের ধাক্কায় তাদের আহত হতে হয়। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মেয়ে নিঝুমকে নিয়ে মিরপুরের পল্লবীতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন সাদেকা বানু। তিনি বলেন, ফুটপাত নেই। রাস্তায় খালি অংশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। এর মধ্যে যদি বাস ধাক্কা দেয়, তবে সব শেষ। এর পরও জরুরি দরকারে রাস্তায় বের হতে হয়।
জানা গেছে, মেট্রো রেল প্রকল্পের জন্য মিরপুর-১২, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, তালতলা অংশে ফুটপাত ও রাস্তা বলতে কিছু নেই। বাস চলে দুলতে দুলতে, এক লেন থেকে আরেক লেনে হুট করে চলে যায়। এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে পথচারীদের চলতে হয়। এই সড়কের কোথাও বাস স্টপেজে বাস থামে না। থামে পথে পথে। গতকাল বিহঙ্গ পরিবহনের বাসে উঠে কুড়িলে আসতে আসতেই দেখা গেল, মিরপুর, বাড্ডা লিংক রোড, গুলশানে গুদারাঘাট, মহাখালীতে তিতুমীর কলেজের সামনে নির্দিষ্ট স্থান ছাড়াই যাত্রীদের তোলে বাসটি। বাসের চালক বাবুল মিয়া বলেন, আগের নিয়ম তাড়াতাড়ি ভাঙা যাবে না।

মোটরসাইকেল আরোহীরা বেশি মারা যাচ্ছে বাসের চাপায়। গত শনিবার জাহাঙ্গীর গেটে ভিআইপি পরিবহনের একটি বাসের চাপায় ৭১ টেলিভিশনের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন নিহত হন। তিনি বারিধারায় তাঁর কর্মস্থলে আর যেতে পারেননি। তাঁর মোটরসাইকেলের ওপর উঠে পড়েছিল বাস। বাসচালকের কাছে বৈধ কোনো কাগজপত্র ছিল না, মামলার স্লিপ ছিল।
সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উদ্যোগে প্রথম ধাপে ৩০টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এর একটি ছিল বাসে দুটি জায়গায় চালক ও চালকের সহকারীর ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর ও মোবাইল ফোন নম্বর প্রদর্শন নিশ্চিত করা। গতকাল মিরপুর থেকে গুলিস্তান রুটে চলা ৩০টি বাসে উঠে ওই নির্দেশনা মানার চিহ্ন দেখা যায়নি। গত মাসে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে ক্যান্টনমেন্টের জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত ‘মডেল করিডর’ চালু করার ঘোষণাও পুলিশ বাস্তবায়ন করেনি। দুর্ঘটনা কমাতে গত মাসে হুট করে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে ১৫৮ রুটে লেগুনা চলাচল বন্ধ করার ঘোষণা দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ। তবে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। আবার প্রধান সড়কে চলছে লেগুনা। কারণ বিকল্প পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়নি। ৯ আগস্ট থেকে চালকদের সঙ্গে চুক্তিতে গাড়ি না চালানোর ঘোষণা দেয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। তবে লোকাল বাসে এ নির্দেশনা মানা হচ্ছে না।
‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের হিসাবে, গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই দুই মাসেই রাজধানীসহ সারা দেশে ৫৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬৭০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আগস্টে ৩০০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৬১ জনের এবং সেপ্টেম্বরে ২৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। এই দুই মাসে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় ১৫ জন, যাদের সাতজনই মোটরসাইকেল আরোহী।
দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুসারে, রাজধানীর ৫১টি মোড়েই বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর, আব্দুল্লাহপুর-মহাখালী অংশে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।

আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সড়কে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করেছে প্রায় আড়াই লাখ। জরিমানা আদায় করেছে প্রায় ১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) রাজধানীতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে। আগে ঢাকায় সংস্থার ভ্রাম্যমাণ আদালত ছিল তিনটি, তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৯টি। বিআরটিএর দেওয়া তথ্যানুসারে, গত সেপ্টেম্বর মাসে ২১৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়, যার বেশির ভাগই করা হয় রাজধানীতে। একই সময়ে চার হাজার ৮৩২টি মামলা হয়েছে এবং প্রায় ৯৭ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নূর মোহাম্মদ মজুমদার গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, মামলা ও জরিমানা আগের চেয়ে বেশি করা হচ্ছে। অভিযানের ফলে ঢাকায় গণপরিবহন একটু কম দেখা যাচ্ছে। তবে মামলার ভয়ে বিআরটিএতে ফিটনেস সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়েছে। সড়ক নিরাপদ করার বিষয়টি হুট করে হবে না। এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটা অব্যাহত রাখতে হবে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা সড়কে শৃঙ্খলার জন্য বাস কাউন্টার করতে চাই। জমির জন্য সিটি করপোরেশনে চিঠি দিয়েছি। চুক্তিতে বাস চালানো নিষিদ্ধ করেছি। তার পরও শতভাগ সাফল্য আসছে না। কারণ এটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। পথচারীদেরও সচেতন হতে হবে। চালকদের আমরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত ২৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে যে ৩০টি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তার বেশির ভাগই প্রক্রিয়ায় ঝুলছে। যেমন—নিউ ডিওএইচএস, জোয়ারসাহারা ও এয়ারপোর্ট রোডে ফুট ওভারব্রিজ পুনর্নির্মাণ করা হয়নি এখনো। কাকলী ইন্টারসেকশনে এলিভেটেড ইউ লুপ বা আন্ডারপাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। হলুদ রং দিয়ে সড়কের পার্কিং লেন আলাদা করার সিদ্ধান্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং ডিএমপির বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি বেশির ভাগ স্থানে। এভাবেই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে।

‘পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছে’ : ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম গত রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত দুই মাসে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছে। মোটরসাইকেলে দুজন আরোহীর সবাই হেলমেট পরেন—এটা বেশির ভাগ রাস্তায় দেখা যায়। মোটরসাইকেলে তিনজন খুব কম চোখে পড়ছে। উল্টো পথে গাড়ি চলাচল করছে কম। জেব্রাক্রসিংয়ে গাড়ি থামছে, লোকজন ইন্টারসেকশন দিয়ে পারাপার হচ্ছে। তবে সব ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করা হচ্ছে না যথাযথভাবে। এখানে জনসচেতনতা দরকার। গণপরিবহনের ক্ষেত্রে লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি কমেছে। তবে ঘনবসতিপূর্ণ শহরে সড়ক ও গাড়ি যত সময় থাকবে, ঝুঁকি তো থাকবেই।’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/10/05/687746