৫ অক্টোবর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:৪৮

সড়ক উন্নয়নে পুকুরচুরি!

৫ হাজার ১৯৯ কোটি টাকার গাজীপুর সিটির তিন প্রকল্প; রাজধানীতে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১.৪৩ কোটি, গাজীপুরে ৫.৫৬ কোটি টাকা

জাতীয় নির্বাচনের আগে চলছে সড়ক ও অবকাঠামো প্রকল্প অনুমোদনের হিড়িক। আর সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নের নামে চলছে পুকুরচুরির মহোৎসব। ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সীমানা নেই। আবার থাকলেও সেটির থোরাই পরোয়া করা হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা শহরে যেখানে এক কিলোমিটার রাস্তা করতে ব্যয় হয় শুধু ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, সেখানে গাজীপুর সিটির মতো ছোট শহরে ব্যয় ধরা হচ্ছে এর প্রায় ৩ গুণ বেশি তথা ৬ কোটি টাকার কাছাকাছি। সড়কের মতোই গাজীপুরের ড্রেন ও ফুটপাথ উন্নয়নে কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সড়ক প্রকৌশলীরা বলছেন, এসব হচ্ছে রাষ্ট্রীয় অর্থের লুটপাট। উন্নয়নের নামে পুকুরচুরি! যেখানে ভারতে চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণব্যয় হয় ১০ কোটি টাকা সেখানে বাংলাদেশে গাজীপুর সিটিতে সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। এই ধরনের অস্বাভাবিক ব্যয়ের কারণে প্রশ্ন জাগে এতে কোনো মহলকে বিশেষ আর্থিক সুবিধা দেয়া হচ্ছে কি না?

সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের কাছে থাকা শুধু গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নেই আলাদা তিন প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গাজীপুরের তিন প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এখানে ওয়ার্ড পর্যায়ে তিন ধরনের রাস্তা নির্মাণ করা হবে। রাস্তা নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে এত টাকা ব্যয় নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনেরই প্রশ্ন রয়েছে। সাধারণভাবে উপজেলা পর্যায়ে সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ৯০ লাখ টাকার মতো। যার সাথে গাজীপুরের কোনো তুলনা করা যাচ্ছে না। শুধু সড়ক নির্মাণেই নয়, গাজীপুরে ফুটপাথ নির্মাণব্যয়ও ঢাকা শহরের ফুটপাথ নির্মাণের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। এর আগে নেয়া রাস্তা ড্রেন ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে ৬৬১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান আছে। এর বাইরে নতুন এই প্রকল্প নেয়া হচ্ছে।
প্রকল্প প্রস্তাবনার তথ্য থেকে দেখা যায়, গাজীপুর জোন ১ ও ৫ নম্বরের রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাথ নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে দু’হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর ২, ৪ ও ৩ নম্বর জোনের জন্য নেয়া প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে দু’হাজার ৮৬০ কোটি ৩০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এছাড়া রাস্তা উন্নয়নের জন্য একটি এ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট করা হবে ৩৮ কোটি ৬০ লাখ ৭০ হাজার টাকায়।

তুলনামূলক বিশ্লøষণে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সড়ক উন্নয়নের জন্য যে প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে সেখানে ২৩৮ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪২ কোটি ২৬ লাখ ১৭ হাজার টাকা। এখানে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়ছে ১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। আর গাজীপুর সিটির ৪৪ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার আরসিসি রাস্তা করা হবে। যার ব্যয় ২৩২ কোটি ৭১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে ৫ কোটি ২৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। আর বিটুমিনের রাস্তা করতে গাজীপুর সিটিতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ৫৬ লাখ ২৪ হাজার টাকা। সিসি রাস্তা করতেও ব্যয় ধরা হয়েছে কিলোমিটারে ২ কোটি ১১ লাখ টাকা।
ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৬২ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার ফুটপাথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭ কোটি ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। কিলোমিটারে ব্যয় হবে ৭৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। অন্যদিকে ফুটপাথ উন্নয়নে কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হযেছে ৬৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। আর গাজীপুর সিটিতে ফুটপাথ-ড্রেন করা হবে ১২৫ দশমিক ৮৪৯ কিলোমিটার। যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৫৫ কোটি ৩০ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। গড়ে কিলোমিটারে ৫ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা ব্যয় হবে।
এদিকে প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণে খোদ পরিকল্পনা কমিশনেই প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পে প্রায় ৫০ কিলোমিটার আরসিসি রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ড্রেন-ফুটপাথ নির্মাণেও কিলোমিটারে খরচ ধরা হয়েছে ৫ কোটি ২২ লাখ টাকা। শুধু জলাবদ্ধপ্রবণ রাস্তাগুলো আরসিসি করার সংস্থান রেখে বাকি রাস্তাগুলো বিটুমিন দিয়ে করার কথা বলা হয়।

পরিকল্পনা কমিশন থেকে বলা হয়েছে, প্রকল্পের কার্যক্রম সঠিকভাবে বাস্তবায়ন এবং গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাস্তবায়ন কাজ তদারকির জন্য পরামর্শক হিসেবে কোনো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে নিয়োজিত করা উচিত। এখানে পরামর্শকের জন্য দুই প্রকল্পে ২০ কোটি টাকার সংস্থান ধরা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদের মতে, গাজীপুরের এই ব্যয় অস্বাভাবিক। রাজধানী এবং গাজীপুর সিটির এক কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে ব্যয়ে এতটা ব্যবধান হতে পারে না। যদি ফুটপাথ, ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণব্যয় একত্রে করা হয়, তাহলে প্রতি কিলোমিটারে গাজীপুরে ব্যয় হচ্ছে ১১ কোটি টাকার বেশি। এটা অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের দ্বারা ক্রসচেক করে দেখা প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, এই ব্যয়ের যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা আমি পাচ্ছি না। এতটা হেরফেরের কোনো যৌক্তিকতা পাচ্ছি না। তবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনো ব্যাখ্যা থাকলে সেটা আমার কাছে নেই।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের দৃষ্টিতে একই দেশে অবকাঠামো নির্মাণে এতটা ব্যবধান হওয়ার কথা নয়। অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয় পার্শ্ববর্তী দেশসহ পৃথিবীর উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি, যা আমাদেরকে উদ্বিগ্ন করে। কর্তৃপক্ষের উচিত এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা। তিনি বলেন, একই ধরনের উন্নয়নকাজ এলাকাভেদে ও কাজের মান ভেদে ব্যয় ব্যবধান কিছুটা হতে পারে। তাই বলে একই দেশের মধ্যে এতটা হেরফের? এখানে কী যুক্তি আছে তা কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছি। পাশাপাশি এটাও প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক এর মাধ্যমে কোনো মহলকে বিশেষ ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে কি না।


http://www.dailynayadiganta.com/first-page/354554