এমপিপুত্র রনি। ফাইল ছবি
৪ অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১১:৪৬

এমপিপুত্র রনির গুলিতে জোড়া খুন

রায়ের আগে গুরুত্বপূর্ণ আলামত গায়েব

ভিডিও ফুটেজের সিডি ও মোবাইল ফোনের সিডিআর যথাযথভাবে জমা দেয়া হয়, কিন্তু এখন গুরুত্বপূর্ণ এসব আলামত পাওয়া যাচ্ছে না -তদন্ত কর্মকর্তা


জোড়া খুনের মামলা থেকে সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনিকে বাঁচাতে মামলার ডকেট থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলামত গায়েব হয়ে গেছে। রায় ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে এসে পাওয়া যাচ্ছে না ঘটনাস্থলের ভিডিও ফুটেজের সিডি এবং মোবাইল ফোনের কললিস্ট বা সিডিআর। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় আদালতপাড়ায় সংশ্লিষ্ট মহলে তোলপাড় চলছে।
সূত্র বলছে, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর যে কোনো উপায়ে আলামত দুটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে জোরেশোরে। তবে আলামত উদ্ধার হোক বা না হোক এ ঘটনার জেরে রায় ঘোষণা আরেক দফা পিছিয়ে যেতে পারে।

২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল রাত দেড়টার সময় রনি হোটেল সোনারগাঁও থেকে মায়ের পাজেরো গাড়িতে বাসায় ফিরছিলেন। রাজধানীর ইস্কাটন এলাকায় তাকে বহনকারী গাড়িটি যানজটে আটকা পড়লে রনি ক্ষুব্ধ হয়ে জানলার গ্লাস খুলে হাতে থাকা পিস্তল দিয়ে গুলি ছোড়েন। এ ঘটনায় রিকশাচালক আবদুল হাকিম ও আইয়ুব আলী নামে অপর এক অটোচালক নিহত হন। আলোচিত এ ঘটনার পর চাপের মুখে রনিকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয় পুলিশ। প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে জেলহাজতে বন্দি আছেন তিনি।
সূত্র জানায়, মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত গায়েবের এ ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা নিজেও উদ্বিঘ্ন। ইতিমধ্যে বিষয়টি তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অফিসিয়ালি জানিয়েছেন। জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই দীপক কুমার দাস বুধবার সকালে যুগান্তরকে বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজের সিডি ও মোবাইল ফোনের সিডিআর যথাযথভাবে জমা দেয়া হয়। কিন্তু এখন গুরুত্বপূর্ণ এসব আলামত পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে ন্যায়বিচারের পথে অবশ্যই প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে, যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।’

ইস্কাটনের জোড়া খুন নামে পরিচিত এ হত্যা মামলাটি দেশজুড়ে আলোচিত। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া পার হয়ে মামলাটি এখন মহানগর দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে রায় ঘোষণার পর্যায়ে আছে। এর আগে ৮ মে রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ করা হলেও পরে তা পিছিয়ে দেয়া হয়। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, যে কোনোদিন এ মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে।
আলামত গায়েবের পর দৌড়ঝাঁপ : মামলার রায় ঘোষণার আগ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ আলামত গায়েব হওয়ার ঘটনা জানাজানি হলে আদালতের কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। পুলিশের প্রসিকিউশন বিভাগও বসে নেই। ইতিমধ্যে তারাও আদালতের উচ্চপর্যায়কে বিষয়টি জানিয়ে প্রতিকার দাবি করেছেন। একই সঙ্গে গায়েব হয়ে যাওয়া আলামতের সন্ধান চলছে।
সূত্র জানায়, তদন্ত কর্মকর্তা মামলার চার্জশিটের সঙ্গে ১৫ ধরনের আলামত জমা দেন। এর মধ্যে ছিল ঘটনাস্থলের কাছের একটি ভবনের সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ ও আসামির অবস্থান প্রমাণের জন্য তার মোবাইল ফোনের সিডিআর। কিন্তু মাত্র কয়েকদিন আগে এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আলামত হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের নজরে আসে। এরপরই চারদিকে আলামত খোঁজাখুঁজি শুরু হয়।

সূত্র বলছে, দুটি গুরুত্বপূর্ণ আলামত গায়েব হয়ে যাওয়ার পর অন্যান্য আলামত যেমন- নিহত ব্যক্তিদের রক্তমাখা লুঙ্গি, উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গুলিসহ আরও যেসব আলামত আদালতের মালখানায় জমা থাকার কথা সেগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ নিয়েও এখন সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে ব্যালিস্টিক রিপোর্ট এখনও সংরক্ষিত আছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। যেখানে বলা আছে, রনির পিস্তলের গুলিতেই দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
বিচারসংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, শুধু আলামত গায়েব নয়, আলোচিত এ মামলার দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় বারবারই নানা অসঙ্গতির দেখা পেয়েছেন তারা। প্রথমদিকে মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে বাদীপক্ষের আইনজীবীদের নানা ধরনের প্রলোভনও দেয়া হয়। তাতে কাজ না হওয়ায় পরে দেয়া হয় হত্যার হুমকি। এমনকি এ ধরনের হুমকি থেকে প্রসিকিউশনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাও বাদ যাননি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নাম ভাঙিয়েও বিচার প্রভাবিত করার অপচেষ্টা হয়েছে। অবশ্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বরাবরই মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে নির্দেশনা আসে।

জবানবন্দি নিয়েও নাটক : মামলায় যে তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তারাও পূর্বের দেয়া জবানবন্দি থেকে সরে আসেন। জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে আদালতকে তারা বলেন, নির্যাতনের মুখে পুলিশের শেখানো কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি মামলার প্রধান ও একমাত্র আসামি বখতিয়ার আলম রনি অদ্যাবধি ঘটনার দায় স্বীকার করেননি। তাকে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে রাজিও করাতে পারেনি পুলিশ। গ্রেফতারের পর বেশিরভাগ সময় তিনি হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনেই কাটিয়েছেন। অল্প কিছুদিন কারাগারে থাকলেও সেখানে তার জন্য সুযোগ-সুবিধার কোনো কমতি ছিল না। বরাবরই রনিকে আদালতে আনা হয়েছে হাতকড়া ছাড়াই। আদালতে হাজির করা হলেও তাকে কখনোই কাঠগড়ায় তোলা হয়নি। তিনি বসতেন সোফায়।

আসন্ন রায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাদীপক্ষ হিসেবে মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত প্রসিকিউটর এসএম জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা আশা করব যতই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হোক না কেন ন্যায়বিচার পাব। কারণ এ মামলায় যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হয় তবে সমাজে এটাই প্রতিষ্ঠিত হবে যে, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়। ফলে আইন সবার জন্য সমান এ বাক্যের কোনো আবেদন সমাজে আর থাকবে না। অতিরিক্ত প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার দুলাল বলেন, এ মামলায় রনির অবশ্যই সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। তা না হলে ধনীর বখে যাওয়া সন্তানরা আরও বেপরোয়া হয়ে পড়বে। তাই এখানে ন্যায়বিচারের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকা খুবই জরুরি। আসামিপক্ষের আইনজীবী ও ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি কাজী নজিবুল্লাহ হিরু বুধবার তার কার্যালয়ে যুগান্তরকে বলেন, এ মামলায় রনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। ঘটনার সঙ্গে রনি কোনোভাবে জড়িত নয় তা নিশ্চিতভাবেই আদালতে প্রমাণ করা গেছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তার মায়ের রাজনৈতিক অবস্থান বিনষ্ট করতে একটি চক্র ষড়যন্ত্র করে রনিকে এ ঘটনায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/97092