৪ অক্টোবর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১৪

কেন এই ধমক ও ভীতির পরিবেশ

মানব সভ্যতা অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আজ এই জায়গায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু ‘এই জায়গাটা’ এখন কেমন? এক কথায় তো এই প্রশ্নের জবাব দেয়া যাবে না। তবে মোটা দাগে বলতে গেলে বলা যায়, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে, তবে এর ব্যবহারবিধি নিয়ে প্রশ্ন আছে।’ বিজ্ঞানের শক্তি মানুষের কল্যাণে কতটা ব্যাবহার হচ্ছে, এমন প্রশ্নের পাশাপাশি এই শক্তি কি এখন আগ্রাসী শক্তির ‘ধমক’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে না- এমন প্রশ্নও প্রকট হয়ে উঠেছে। বর্তমান সভ্যতায় অনেক কুসংস্কার দূর হয়েছে, আবার সৃষ্টিও হয়েছে নতুন নতুন কুসংস্কার। এগুলোকে বলা চলে আলো ঝলমলে জাহেলিয়াত। বর্তমান সভ্যতায় বিশ্বরাজনীতির আগ্রাসন খুবই নিষ্ঠুর এবং ব্যাপক। শক্তিমানরা জোটবেঁধে এবং আঞ্চলিক এজেন্ট মনোনয়ন দিয়ে ইচ্ছেমতো অপরাধ করে যাচ্ছে। ছোট রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও মানসম্মানের কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে। রাজনীতি এখন আর মানুষের রাজনীতি নেই, হিংস্র হায়েনার রূপ ধারণ করেছে। তবে এই রূপকে আড়াল করতে শক্তিমানরা এখন মুখোশ ব্যবহারে বেশ পরিপক্ব হয়ে উঠেছে।

নিজেদেরকে তারা মহান-উদার, মানবতাবাদী, যুদ্ধবন্ধে মীমাংসাকারী ও শান্তির অগ্রদূতের আসনে অধিষ্ঠিত করে রেখেছেন। আর দরিদ্র, শোষিত-বঞ্চিত, যুদ্ধ-বিপর্যস্ত মজলুম জনগোষ্ঠীকে সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী ও অশান্তির হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছে। এমন মিথকে বর্তমান সভ্যতায় দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদের প্রপাগাণ্ডা যুদ্ধের কোনো তুলনা নেই। এই যুদ্ধে নিজ দেশের বাইরেও তাদের রয়েছে বহু এজেন্ট, তাঁবেদার এবং গোলাম। ছোট-বড় বহু রাষ্ট্রকে তারা তাদের আগ্রাসী বিশ্বব্যবস্থায় যুক্ত করে ফেলেছে, মেলে ধরেছে স্বার্থের নানা টোপ। এমন বাস্তবতায় বর্তমান সভ্যতায় নীতি, আদর্শের বদলে স্বার্থান্ধতার দৌরাত্ম্য চলছে রাজনীতির ময়দানে। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, ওরা তো খারাপ, আপনারা ভালো, তাহলে এতো যুদ্ধ চলছে কেমন করে? ওরা তো অস্ত্র বানায় না, অস্ত্র তো বানান আপনারা, সরবরাহও করেন আপনারা। তাহলে যুদ্ধের কারিগর কি আপনারা নন? এই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তাদের কাছে নেই। বর্তমান সভ্যতার শাসকদের মুখোশ উন্মোচনের জন্য এই একটি প্রশ্নই যথেষ্ট।

সভ্যতার-অভিঘাত বলে একটি কথা আছে। ছোট ছোট রাষ্ট্রের রাজনীতিতেও বিশ্ব রাজনীতির প্রভাব পড়েছে। আদর্শনিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতিক্ষার আকাল চলছে এখন রাজনীতিতে। ক্ষমতায় আরোহণই রাজনীতির মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। ফলে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধকে দেয়া হয়েছে বিসর্জন। এমন শূন্যতায় রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের মাত্রা বাড়ছে। এমন অবস্থায় অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি ও জনদুর্ভোগের মাত্রাও যায় বেড়ে। এসবের খবর পত্র-পত্রিকা ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সরকারের ইমেজ ক্ষুণœ হয়, জনপ্রিয়তায় ধস নামে। তখন সরকার সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চায়। তৈরি করে নিত্যনতুন আইন-কানুন, সৃষ্টি করে ভয়ের পরিবেশও। লক্ষ্য গণমাধ্যম যেন অকার্যকর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশও এর থেকে মুক্ত নয়। এমন অবস্থায় সরকারের শুভবুদ্ধি আমাদের কাম্য। তবে শুভবুদ্ধি এখন যেন দুর্লভ বিষয়। তাই তো লক্ষ্য করা যায় প্রতিবাদের দৃশ্য।
সাংবাদিকসহ গণমাধ্যম কর্মীরা অব্যাহতভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধিতা করে আসছেন। জনমনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন এই বিরোধিতা? এমন প্রেক্ষাপটে সম্পাদক পরিষদের ব্যাখ্যা তুলে ধরা যায়। তাহলে বিষয়টি সবার কাছে স্পষ্ট হতে পারে।
জাতীয় সংসদে সদ্য পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কিছু মৌলিক ত্রুটি আছে, সে ব্যাপারে সম্পাদক পরিষদের ব্যাখ্যা হলো-
১. ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটন প্রতিহত করা এবং ডিজিটাল অঙ্গনে নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের চেষ্টা করতে গিয়ে এমন একটি আইন করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের কর্মকা-ের ওপর নজরদারি, বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের সংবিধান প্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
২. এই আইন পুলিশকে বাসা-বাড়িতে প্রবেশ, অফিসে তল্লাশি, লোকজনের দেহ তল্লাশি এবং কম্পিউটার, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, সার্ভার ও ডিজিটাল প্লাটফর্ম সংক্রান্ত সবকিছু জব্দ করার ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়েছে। পুলিশ এই আইনে দেয়া ক্ষমতা বলে পরোয়ানা ছাড়াই সন্দেহবশত যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে। এক্ষেত্রে পুলিশের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন নেই।

৩. এই আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৫. এই আইন সংবাদমাধ্যমের কর্মী ছাড়াও কম্পিউটার ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ইত্যাদি ব্যবহারকারীরা সব ব্যক্তির মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করবে।

সরকার পক্ষের বক্তব্য অবশ্য অন্যরকম। তারাতো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দোষের কিছু দেখছেন না। ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) প্রণীত হওয়ার সময় সরকার বলেছিল, সাংবাদিকদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই; কারণ আইনটি করা হয়েছে সাইবার অপরাধ ঠেকানো ও সাইবার অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার লক্ষ্যে। বাস্তবতা হলো, সাংবাদিকসহ অন্য যারা স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করতে গেছেন, তারা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কারাভোগ করেছেন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। সম্পাদক পরিষদ তাদের ব্যাখ্যায় ওইসব উদাহরণ তুলে ধরে বলেছেন, এখনো একইভাবে বলা হচ্ছে যে, সাংবাদিকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ঘটেনি, কিন্তু আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে যে, এই আইনেও সাংবাদিকরা আবার একই ধরনের হয়রানির মুখোমুখি হবেন। কারণ এই আইন স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রকৃতির পরিপন্থী এবং তা অনুশীলনের প্রতিকূল, যে সাংবাদিকতা জনগণের জানার অধিকার সুরক্ষা করে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি জনসমক্ষে উন্মোচন করে। সম্পাদক পরিষদের ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়েছে, অন্য ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োজন ‘নিয়ন্ত্রণ’, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজন ‘স্বাধীনতা’। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কেন্দ্রীয় বিষয় কেবলই ‘নিয়ন্ত্রণ’, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা এতে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্যতম মৌলিক ত্রুটি, এর ফলে এই আইন সংবাদমাধ্যমের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আমরা মনে করি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রত্যাখ্যানের ব্যাপারে সম্পাদক পরিষদ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা খুবই স্পষ্ট এবং গ্রহণযোগ্য। বাংলাদেশের সম্পাদকদের বক্তব্য মেনে নেয়ার মধ্যে রয়েছে সবারই কল্যাণ।

http://www.dailysangram.com/post/347940