৩ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ৯:৫২

ঢাকা ওয়াসায় হচ্ছেটা কী

ঢাকা ওয়াসার অর্গানোগ্রামে পরিচালক পদ বলে কিছু নেই। তবুও এই পদে দুই ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের প্রথম দিকে। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান ছুটিতে থাকলে এমডির দায়িত্ব পালন করেন এদের একজন। তাকসিম এ খানের অনুপস্থিতিতে দাপ্তরিক সব ফাইলপত্রেও স্বাক্ষর করেন একজন পরিচালক। এককথায় এমডির যাবতীয় দায়িত্বই থাকে তার। এ নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ওয়াসাকে একাধিক চিঠিপত্র দিয়ে কারণও জানতে চেয়েছে। কিন্তু ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান কর্ণপাত করেননি। এ নিয়ে ওয়াসা প্রশাসন ও ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সদস্যদের মধ্যেও ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান সমকালকে বলেন, ঢাকা ওয়াসায় যে দু'জন পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সেখানে বোর্ড অনুমোদন দেয়নি। কারণ ওয়াসার অর্গানোগ্রামে (জনবল কাঠামো) পরিচালকের কোনো পদ নেই। অর্গানোগ্রাম অমান্য করে ওই দু'জনকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদেরই একজনকে এমডির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, যা অবৈধ।

ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, গত ২০ আগস্ট ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান যুক্তরাষ্ট্রে যান। সে সময় তাকসিম এ খান পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেমকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে যান। সেখানে তিনি বলেন, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করবেন। এ সময় আবুল কাশেম এমডির প্রতিনিধিত্ব করবেন। এ ছাড়া রুটিন কার্যাদি সম্পাদন করবেন। প্রয়োজনে তার সঙ্গেও ই-মেইলে, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ করবেন। ওই এক মাস আবুল কাশেম এমডির দায়িত্ব পালন করেন। গত ১ অক্টোবর তাকসিম এ খান এক সপ্তাহের জন্য আবার ফিলিপাইনে যান। এই সময়ের জন্য আবারও আবুল কাশেমকে এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

নেপথ্য কাহিনী :জানা যায়, ২০১৭ সালের প্রথম দিকে ঢাকা ওয়াসার তিনটি উপব্যবস্থাপনা পরিচালকের (ডিএমডি) পদ শূন্য হয়। ওই বছরের ৭ জুলাই ওয়াসা বোর্ড তিনজনকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। আবেদনকারীদের মধ্যে ঢাকা ওয়াসার সাবেক ডিএমডি ড. লিয়াকত আলী, ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইইবি) সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মঞ্জুর মোর্শেদ ও নন্দন কুমার রায় নামের তিনজন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মন্ত্রণালয় তাদের ডিএমডি পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য চিঠিও ইস্যু করে। কিন্তু এমডির পছন্দের কোনো ব্যক্তি এই তিনজনের মধ্যে না থাকায় এতে আপত্তি দেন। ওই পরীক্ষায় ঢাকা ওয়াসার সাবেক প্রধান প্রকৌশলী অবসরপ্রাপ্ত আবুল কাশেম ও অবসরপ্রাপ্ত একেএম শহিদ উদ্দিনও আবেদন করেন। কিন্তু তারা উন্নীত হতে পারেননি। জানা যায়, এ দু'জন ছিলেন এমডির পছন্দের তালিকায়। এমডির আপত্তির কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। পরে ২৫২তম বোর্ড সভায় এমডি তাকসিম এ খান প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে, তিনজন ডিএমডির পদ শূন্য থাকায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবুল কাশেম ও একেএম শহিদ উদ্দিনকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। বোর্ড এ প্রস্তাব অনুমোদন করেনি। বোর্ড জানায়, ওয়াসার অর্গানোগ্রামে এ ধরনের কোনো পদ নেই। যে কারণে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কিন্তু এরপর একতরফাভাবে আবুল কাশেমকে পরিচালক (উপদেষ্টা) ও একেএম শহিদ উদ্দিনকে পরিচালক (কারিগরি) হিসেবে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ সময় তারা গাড়ি-জ্বালানি ছাড়াও মাসিক এক লাখ ৫০ হাজার টাকা করে বেতন পাবেন। গত ১৯ মার্চ থেকে তাদের নিয়োগ কার্যকর হয়। এর পর থেকেই তারা অফিসিয়াল ফাইলপত্রে স্বাক্ষর করছেন ও নিয়মিত অফিস করছেন। আর এমডি বিদেশ গেলেই আবুল কাশেম এমডির দায়িত্ব পালন করছেন।

মন্ত্রণালয়ের বারবার আপত্তি :গত ৯ মে এই নিয়োগের ব্যাপারে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. কেএম কামরুজ্জামান সেলিম ওয়াসার এমডিকে চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬-এ পরিচালক পদ সৃজনের কোনো সুযোগ আছে কি-না, থাকলে সেই ধারার বিবরণ দিয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) চাকরি প্রবিধানমালা ২০১০-এর অর্গানোগ্রামে উক্ত পদ সৃজনের বিধান রয়েছে কি-না, থাকলে বিধানের বর্ণনা দিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে। কিন্তু ওয়াসা কোনো উত্তর দেয়নি।

গত ২৫ জুলাই স্থানীয় সরকার বিভাগ আরেকটি চিঠি দিয়ে জানায়, ওয়াসার আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ তার কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ দিতে পারবে। তবে সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে কোনো জনবল নিয়োগ দিতে হলে আগে সরকারের কাছে পেশ করতে হবে। সরকার অনুমোদন দিলে নিয়োগ দিতে পারবে। অথচ দু'জন পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিচালকের পদ সৃষ্টি না করে উক্ত পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞাপন, যোগ্যতা নির্ধারণ ও পরীক্ষা গ্রহণ না করে এবং অন্যান্য কার্যাবলি সম্পাদন না করেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যা আইন ও সরকারের সাধারণ নীতির পরিপন্থী বলে প্রতীয়মান হয়।

এ ঘটনার পর গত ৫ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আবারও ওয়াসার এমডিকে চিঠি দিয়ে জানায়, এই নিয়োগ 'পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ আইন ১৯৯৬ ও পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিস্কাশন কর্তৃপক্ষ (কর্মকর্তা/কর্মচারী) চাকরির প্রবিধানমালা ২০১০-এর সংশ্নিষ্ট ধারার পরিপন্থী। এটি বিধিসম্মত না হওয়ায় ঢাকা ওয়াসার দু'জন পরিচালক পদে নিয়োগ বাতিলের জন্য কেন অনুশাসন প্রদান করা হবে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যাসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠাতে বলা হয়। পরিচালক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দু'জন পরিচালকের বেতন-ভাতা বন্ধসহ তাদের দাপ্তরিক সব কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে পত্র মারফত স্থানীয় সরকার বিভাগকে অবহিত করার জন্য বলা হয়।

এই কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবে ১৯ আগস্ট তাকসিম এ খান মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দিয়ে জানান, তিনজন ডিএমডির পদ শূন্য। এ অবস্থায় স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার জন্য ২৫২তম বোর্ড সভায় এ নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। ওই সভায় ১৫ জন বোর্ড সদস্যের মধ্যে আটজন উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে পাঁচজন মত দিয়েছেন। কাজেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টিতে আইনের ব্যত্যয় ঘটেনি। বিধি মোতাবেক হয়েছে।

তবে এ প্রসঙ্গে বোর্ড চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান সমকালকে জানান, বোর্ড সভায় এমডি বিষয়টি তুলেছিলেন। কিন্তু কেউ নিয়োগের পক্ষে মত দেননি। কাজেই সেটা অনুমোদন হয়নি।

এ অবস্থায় আবার আবুল কাশেমকে এমডির দায়িত্ব দিয়ে গত ১ অক্টোবর ফিলিপাইনে গেছেন এমডি তাকসিম এ খান। এ প্রসঙ্গে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ প্রসঙ্গে এমডির দায়িত্ব পালনকারী আবুল কাশেম সমকালকে বলেন, মন্ত্রণালয় তার নিয়োগ নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছিল। কিন্তু সম্প্রতি তিনি আর কিছু শুনছেন না। বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন। এমডির অনুপস্থিতিতে তিনি রুটিন ওয়ার্ক করে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, ওয়াসার অর্গানোগ্রামে না থাকলে পরিচালক পদে লোক নিয়োগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটা কীভাবে হলো, সেটা দেখবেন বলে জানান।
বিষ

http://samakal.com/capital/article/1810134