৩ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ৯:৪৮

গায়েবি মামলার পাহাড়

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া মামলা দায়ের উচিত নয় : কাজী রিয়াজুল হক
গায়েবি মামলা প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে : আব্দুল কাইয়ুম
মিথ্যা মামলায় কাউকে হয়রানির সুযোগ নেই : মো. সোহেল রানা

লঘু অপরাধে কারাবন্দিদের কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে


সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গণহারে গায়েবি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ উঠেছে। গত রোববারের বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের কাজে বাধা দেয়া, হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করা এবং নাশকতামূলক কর্মকান্ডের অভিযোগে ঢাকার ৩৩টি থানায় ৪২টি মামলায় ১৯০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ১৫০ জনকে গতকাল আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। রাজধানীসহ সারাদেশে গত দু’দিনে আরো ৫ শতাধিক বিএনপির নেতাকর্মীকে গায়েবি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ছিনতাই, খুন ও মাদক ব্যবসায়ীসহ নানা অপরাধে জড়িতদের গ্রেফতার বাদ দিয়ে গায়েবী মামলার আসামীদের গ্রেফতারে সময় দিতে হচ্ছে। এতে করে ছোট ছোট অপরাধ বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। শুধু তাই নয়, অপরাধীরা সুযোগ ফেলে এক সময় বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে।
কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের কারাগারগুলোর বর্তমানে বন্দি ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৪০ হাজার। কিন্তু বর্তমানে দেশের ৭০টি কারাগারে প্রায় বন্দী রয়েছে ৮০ হাজার। অপ্রতুল জনবল নিয়ে এদের সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। এছাড়া গায়েবী মামলায় প্রতিদিন শত শত বন্দী যোগ হওয়ায় বন্দীদের থাকা ও খাওয়াসহ দেখাশুনা করতে ত্রাহি অবস্থার মধ্যে পড়তে হচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষকে। পুলিশ, কারা কর্তৃপক্ষ ও আদালত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দাবি, গত পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৪ হাজার ৯৪টি গায়েবী মামলা দেয়া হয়েছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৩১৯ জন। এসব মামলায় আসামী করা হয়েছে ২ লাখ ৭২ হাজার ৭২০জন। এসব গায়েবী মামলার কোন অস্তিত্ব নেই। পুরোপুরি ভৌতিক মামলা।

কারাগার সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে দেশের কারাগারগুলোতে থাকা লঘু দন্ডে সাজাপ্রাপ্ত ২ হাজারের অধিক বন্দিকে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ মুক্তি দেয়া হয়েছে। মুক্তির তালিকায় রয়েছে ৫ হাজার ৫শ ৭৫জনের নাম। তবে আইনজীবী, ও মানবাধিকার কর্মীদের আশঙ্কা, আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে। তখন আন্দোলন ঠেকাতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেফতার করা হতে পারে। এ কারণে এখন কারাগার খালি করা হচ্ছে।
আইন-শৃংখলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ৪২টি গায়েবী মামলায় এরই মধ্যে আসামী করা হয়েছে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্ট্যার মওদুদ আহমদ, নজরুল ইসলাম খান, ঢাকা মহানগর বিএনপি দক্ষিণ সভাপতি হাবিবুন নবী খান সোহেল, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ অনেক নেতাকে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল ২ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় ৪হাজার ৬শ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামী করা হয়েছে ২ লাখ ৭৩হাজার ২০জনকে। যাদের সবাই বিএনপি দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থক। এছাড়া গত ৩ দিনে রাজধানীসহ সারাদেশে প্রায় ৫শ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীতে গত রোববার ৩৩টি থানায় ৪২টি মামলায় ১৯০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গত ৩ দিনে রাজধানীসহ সারাদেশে বিএনপির শীর্ষ নেতাসহ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৫শ গায়েবি মামলা দেয়া হয়েছে। পুলিশের তৈরি করা ফরম্যাটে সময় মতো বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে সেগুলো ব্যবহার করা হয়। এবারও পুলিশ তাই করেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সরকার ছক ধরে এগুচ্ছে। সারাদেশ নিঃশব্দ ও জনশূন্য করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বিএনপি মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ সারাদেশে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা সেটিই প্রমাণ করে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, সুনিদিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার বা কারো বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা উচিত নয়। আইন-শৃংখলা বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন ঘটনা ছাড়াই মামলা দায়ের করার যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়ে সর্তক হতে হবে। এ ধরণের মামলার মাধ্যমে যেন সাধারন মানুষ হয়রানীর শিকার না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সাবেক আইজিপি আব্দুল কাইয়ুম দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। পুলিশকে দিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবী মিথ্যা মামলা ও অন্যায়ভাবে গ্রেফতার-নির্যাতনের ঘটনার মাধ্যমে এ প্রতিষ্ঠানটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। এতে সাধারন মানুষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। পুলিশকে অপরাধ নিয়ন্ত্রনের চেয়ে মিথ্যা মামলার আসামীদের গ্রেফতারে সময় ব্যয় করতে হচ্ছে, এতে করে অপরাধীরা ছাড় পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠার সম্ভাবনাও রয়েছে। তিনি আরো বলেন, গায়েবী মামলার বাদি ও তদন্তকারী কর্মকর্তারা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আতংকে রয়েছেন। ওই কর্মকর্তারা বুঝতে পারছেন যে তাদের দিয়ে অন্যায় ও মিথ্যা কাজ করানো হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই পুলিশ প্রধান বলেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের যেভাবে গ্রেফতারের পর কারাগারে পাঠানো হচ্ছে এতে করে মানবাধিকার মারাত্বকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, যারা আইন প্রয়োগ করবেন তাদের দিয়ে অন্যায় কাজ করা হচ্ছে। এতে করে গায়েবী মামলার সাথে জড়িতরা অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠাও সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সম্প্রতি সময়ে দায়েরকৃত বেশ কিছু মামলা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মোঃ সোহেল রানা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, মিথ্যা মামলার মাধ্যমে কাউকে হয়রানী করার সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মামলা দায়ের ও তদন্ত করার বিষয়ে পুলিশ সদরদফতরের সুস্পষ্ট্র নির্দেশ রয়েছে।

কারা সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৮ বিভাগের কারাগারগুলোতে লঘু দন্ডে সাজাপ্রাপ্ত হাজতীদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার ৭৭৫ জনকে পর্যায়ক্রমে মুক্তি দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে পুরুষ ৫ হাজার ৪শ ৯১ জন ও নারী বন্দির সংখ্যা ২শ ৮৪ জন। বিভাগ হিসেবে ঢাকা বিভাগে ১ হাজার ২শ ৪৩ জন, ময়মনসিংহে ২শ ৩৭, রাজশাহীতে ১ হাজার ৩শ ২৩ জন, রংপুরে ৩শ ৭৫ জন, খুলনায় ৬শ ৪ জন, বরিশালে ৪শ ৩৬ জন, যশোরে ১ হাজার ৪শ ৯ ও সিলেট বিভাগে ১শ ৪৮ জন বন্দিকে মুক্তি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

গায়েবী মামলায় আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে পুলিশ বলেছে, গ্রেফতারকৃত সব আসামি বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। এরা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় অবস্থান নিয়ে যানচলাচলে বাধা দেন, সরকার বিরোধী স্লোগান দেন। এ ছাড়া পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন, ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটান এবং নাশকতা মূলক কর্মকান্ড ঘটায়। এসব ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য আসামিদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত ১শ ৩৪ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন।

তবে গ্রেফতারকৃত আসামিদের আইনজীবীরা আদালতের কাছে দাবি করেন, হয়রানি করার জন্য পুলিশ এসব আসামিকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে মামলায় গ্রেফতার দেখিয়েছে। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ আদালতের কাছে দাখিল করতে পারেনি পুলিশ। শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদিকে, সাভার থানা-পুলিশ গত বছরের নভেম্বর মাসের পুরোনো মামলায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে পাঠায়। পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করলে আদালত তা নাকচ করে দেন। আদালত আদেশে বলেন, এসব আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার ঢাকায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছে, মতিঝিল থানায় ১৭ জন, ওয়ারী থানায় ১৩ জন, পল্টন থানায় ১৪ জন, শাহজাহানপুর থানায় ১১ জন, সবুজবাগ থানায় ৯ জন, রামপুরা থানায় ৮ জন, কদমতলী থানায় ৮ জন, খিলগাঁও থানায় ৮ জন, মুগদা থানায় ৮ জন, যাত্রাবাড়ী থানায় ৪ জন, শ্যামপুর থানায় ২ জন, গুলশান, খিলক্ষেত থানায় ১ জন, উত্তরা পশ্চিম থানায় ১ জন, নিউমার্কেট থানায় ৫ জন, কলাবাগান থানায় ৪ জন, দারুস সালাম থানায় ২ জন, হাজারীবাগ থানায় ৭ জন, ধানমন্ডি থানায় ১ জন, রমনা থানায় ১০ জন, শাহবাগ থানায় ৬ জন, বাড্ডা থানায় ৬ জন, বনানী থানায় ২ জন, ভাটারা থানায় ২ জন, তেজগাঁও থানায় ৪ জন, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় ৫ জন, হাতিরঝিল থানায় ৭ জন, কোতোয়ালি থানায় ৩ জন, পল্লবী থানায় ৩ জন, মোহাম্মদপুর থানায় ৩ জন, চকবাজার থানায় ৬ জন, কামরাঙ্গীরচর থানায় ৪ জন এবং সাভার থানায় ৯ জন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে হঠাৎ করে দেশের কারাগারগুলোয় বন্দীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। #

https://www.dailyinqilab.com/article/157106