৩ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ৯:৪৫

জনতা ব্যাংকের পরিস্থিতি খুবই নাজুক

মনিটরিংয়ের অভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খারাপ হচ্ছে, যা একসঙ্গে প্রকাশ পেলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে -খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

জনতা ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। ব্যাংকটির সব সূচক এখন নিুমুখী। পুরনো খেলাপির চাপ, নতুন করে বিপুল অঙ্কের খেলাপি, প্রভিশন ঘাটতি এবং তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকটিকে টাকা ধার করে চলতে হচ্ছে।

এছাড়া জুন শেষে বড় ধরনের আর্থিক লোকসানের পাশাপাশি ব্যাংকটির লোকসানি শাখাও বেড়েছে। এছাড়া নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে জনতা ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নেতিবাচক রেকর্ড করছে। জনতা ছাড়া চারটি ব্যাংকের ২২ থেকে ৫৭ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ রয়েছে।
বিপুল অঙ্কের খেলাপি থেকে কিছুতেই ব্যাংকগুলো বেরিয়ে আসতে পারছে না। কারণ শীর্ষ খেলাপি থেকে ঋণ আদায় করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম ভেঙে বিশেষ সুবিধা দিয়ে প্রভাবশালীদের ঋণ পুনঃনবায়ন করতে বাধ্য হচ্ছে।

মঙ্গলবার রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনাবিষয়ক বৈঠকে জনতা ব্যাংকের এমন পরিস্থিতি উঠে আসে। এজন্য উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্যবেক্ষক ও রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের এমডিরা উপস্থিত ছিলেন।

সূত্র জানায়, বৈঠকে বেসিক ব্যাংক নিয়ে বেশি আলোচনা হলেও ঘুরেফিরে জনতা ব্যাংকের নাজুক অবস্থার বিষয়টি চলে আসে। এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হয়।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যাংকিং সূচকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বেড়েছে ঋণ অবলোপন। আমানত কমেছে। বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতি। লোকসানি শাখাও বাড়ছে। বাড়ছে আর্থিক নিট লোকসান।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, জনতা একসময় ভালো ব্যাংক ছিল। এর আড়ালেই অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এতদিন চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতি গোপন অসুখের মতো।
একসময় প্রকাশ পাবেই। তিনি বলেন, মনিটরিংয়ের অভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খারাপ হচ্ছে, যা একসঙ্গে প্রকাশ পেলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, জনতা ছাড়াও বৈঠকে চার ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপি থেকে ঋণ আদায়ের হার কম থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। একটি ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা।

কিন্তু গত ছয় মাসে এর থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ২৭ কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যাংকেরও একই অবস্থা। এছাড়া জনতা ব্যাংকের লোকসানি শাখা কমিয়ে আনার তাগিদ দেয়া হয়। সূত্র জানায়, গত ছয় মাসে জনতা ব্যাংকের দুটি লোকসানি শাখা বেড়েছে। এছাড়া বাকি চার ব্যাংকের লোকসানি শাখা কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের ১ লাখ ৫০ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা, যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২৮ শতাংশ। ছয় মাস আগে এ ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩৬ হাজার ৫২২ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৬ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ১৩ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৫ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা।
এছাড়া বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ায় গত জুন শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৯ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২২ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় জুন শেষে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি।

জানুয়ারি-জুন সময়ে ব্যাংকটির লোকসান হয় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। মূলত খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়েই লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। ২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৯৭ কোটি টাকা। এর আগের বছরে ২৫১ কোটি টাকা মুনাফা করে ব্যাংকটি।
জনতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকারি সিদ্ধান্তে আমানতের সুদহার কমানোর কারণে আমানত তুলে নিচ্ছে গ্রাহকরা। এছাড়া এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির ঋণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অনিয়মের কারণে কিছু ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এছাড়া ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর প্রায় পুরোটাই খেলাপি করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে ক্রিসেন্ট লেদারের ৬৩৭ কোটি টাকা, রূপালী কম্পোজিটের ৬৫০ কোটি টাকা, লেক্সকো লিমিটেডের ৪১০ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট ট্যানারির ১৫৮ কোটি টাকা ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের ৮৭২ কোটি টাকা। তবে সবমিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সুবিধা পেয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ।

এরই মধ্যে গ্রুপটির পাঁচ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ আদায়ে বন্ধকি সম্পদ বিক্রির জন্য নিলাম ডেকেছে জনতা ব্যাংক। এভাবে ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা আদায় করতে চায় ব্যাংকটি। নিলামকৃত সম্পদের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সাড়ে ১৬ শতাংশ প্লট, সাভার ও হাজারীবাগের জমি, যন্ত্রপাতিসহ কারখানা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নিলামের পণ্যও দায় পরিশোধ করতে পারবে না। কারণ দায় আরও বেশি।

ব্যাংকটির তারল্য সংকটের কথা তুলে ধরে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছেন জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে আমানত ও ঋণের সুদহার যথাক্রমে ৬ ও ৯ শতাংশ কার্যকর করা হয়।
এ কারণে ক্রমান্বয়ে ব্যাংকের আমানত কমতে থাকে। এতে জুলাই ও আগস্টে ২ হাজার ৬১২ কোটি টাকা আমানত কমে যায়।
আমানত কমে যাওয়ায় ব্যাংকটি তারল্য সংকটে পড়ে। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে হচ্ছে। এসব দিয়ে নগদ জমার হার (সিআরআর) সংরক্ষণ করতে হচ্ছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/96807