৩ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ৯:৪৩

শীর্ষ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ে ব্যর্থ রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের অসন্তোষ

বেহাল অবস্থার মুখে পড়েছে সরকারি মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংক। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এসব ব্যাংকের খেলাপি ও মন্দ ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। সেই সাথে নতুন করে মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে পারছে না; বরং আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে ধরেছে ব্যাংক পাঁচটির খেলাপি ঋণ। আর এ খেলাপি ঋণের প্রায় শতভাগই মন্দ ঋণ বা আদায় অযোগ্য ঋণে পরিণত হচ্ছে; বেড়েছে জালজালিয়াতির পরিমাণ। এমনি পরিস্থিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। জালজালিয়াতি বন্ধ করাসহ খেলাপি ঋণ আদায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গতকাল রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনাবিষয়ক বৈঠকেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। গভর্নর ফজলে কবিরের সভাপতিত্বে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, নির্বাহী পরিচালক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্যবেক্ষক ও রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের এমডিরা উপস্থিত ছিলেন।

ব্যাংক পাঁচটির সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচ ব্যাংকের ১ লাখ ৫০ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা বিতরণের বিপরীতে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা; যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ২৮ শতাংশ। ছয় মাস আগে এ পাঁচ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩৬ হাজার ৫২২ কোটি টাকা বা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৬ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ১৩ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ৫ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ায় গত জুন শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৯ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২২ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় গত জুন শেষে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। জানুয়ারি-জুন সময়ে ব্যাংকটির লোকসান হয় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। মূলত খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়েই লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। ২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৯৭ কোটি টাকা। এর আগের বছরে ২৫১ কোটি টাকা মুনাফা করে ব্যাংকটি।

বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে জনতা ব্যাংকের জালজালিয়াতি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিসেন্ট গ্রুপ, এননটেক্সের ঋণজালিয়াতি সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারিকেও ছাড়িয়ে গেছে। এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের কাছেই ব্যাংকটির ঋণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অনিয়মের কারণে কিছু ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর প্রায় পুরোটাই খেলাপি করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটি শীর্ষ ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে তেমন কোনো ঋণই আদায় করতে পারেনি।
বৈঠকে জনতা ছাড়াও অন্য চার ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপি থেকে ঋণ আদায়ের হার কম থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন, সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে আটকে আছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা টাকা; কিন্তু গত ছয় মাসে আদায় হয়েছে মাত্র ২৭ কোটি টাকা। অন্যান্য ব্যাংকেরও একই অবস্থা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংকগুলো জালজালিয়াতি বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা হরহামেশাই অমান্য করে চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো প্রতি তিন মাস অন্তর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সার্বিক আর্থিক সূচক পাঠিয়ে থাকে। ব্যংকগুলো যে আর্থিক অগ্রগতির সূচক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাঠায়, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিল পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ঋণ নবায়নসহ নানা ঋণজালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে আসে। ঋণ নবায়ন থেকে শুরু করে খেলাপি ঋণের তথ্য প্রদর্শনসহ নানা ধরনের ঋণ জালিয়াতির আশ্রয় নেয় এসব ব্যাংক।
গতকালের বৈঠকে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে ঋণকার্যক্রমে অধিকতর সতর্ক হতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে বড় ঋণ কমিয়ে ছোট ছোট ঋণ অর্থাৎ এসএমই ঋণ বেশি হারে বিতরণ করতে বলা হয়েছে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/353966