রাজধানীতে বিশ্বব্যাংকের সংবাদ সম্মেলন : নয়া দিগন্ত
৩ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ৯:৪০

বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণে বিশ্বব্যাংকের উদ্বেগ

চার চাপে সামষ্টিক অর্থনীতি

চলতি অর্থবছরে (২০১৮-১৯) বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। মেগা প্রকল্পে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদার কারণে এই প্রবৃদ্ধি ঘটবে। কিন্তু ব্যবসায় পরিবেশে উন্নতি না হওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগে তেমন উন্নতি হয়নি। সংস্থাটি বলছে, সামষ্টিক অর্থনীতি চার ধরনের চাপের মুখে আছে। এগুলো হলোÑ খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন, বিদেশি অর্থায়নের ঘাটতি, তারল্য সঙ্কট এবং বাজেট ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি। ব্যাংকিং খাতে বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক এই দাতাসংস্থাটি। অন্য দিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি টেকসই হচ্ছে না। কারণ বেসরকারি বিনিয়োগ সে অনুপাতে হচ্ছে না। অনেকটা স্থবিরই আছে। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ অর্থায়নের দিকে ঝুঁকেছি।
আগারগাঁওয়ে বিশ্বব্যাংক তাদের ঢাকা দফতরে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আউটলুক প্রকাশ করে এই তথ্যগুলো জানানো হয়। অনুষ্ঠানে প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। বক্তব্য রাখেন সংস্থার কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর এবং বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের মিডিয়া বিভাগের প্রধান মেহরিন এ মাহবুব।

বিশ্বব্যাংক বলছে, এই প্রবৃদ্ধির সুফল কারা পাচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রবৃদ্ধিকে সংখ্যা দিয়ে না দেখে গুণগত মান দিয়ে দেখা উচিত। প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে কি না, তা দেখতে হবে। এ ছাড়া ঋণ পুনঃতফসিলের কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাবে। এতে চাপ বাড়বে বাজেটে। এ জন্য আর্থিক খাতে সংস্কার আনতে হবে। আর এই পুনঃতফসিলের পেছনে রাজনৈতিক চাপও থাকে। তারা বলছে, গত অর্থবছরে খেলাপি ঋণের হার ১০ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। মোট খেলাপি ঋণের ৪৮ শতাংশই রাষ্ট্র মালিকানাধীন ছয় ব্যাংকে। ৪০টি বেসরকারি ব্যাংকে আছে ৪৪ শতাংশ খেলাপি ঋণ।
বিশ্বব্যাংক মনে করে, বেসরকারি খাতে বিপুল বিনিয়োগ দরকার। বড় অবকাঠামোতে আরো সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ করতে হবে। প্রবাসী আয় ও রফতানি আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে নতুন ভ্যাট আইনটির বাস্তবায়ন করা জরুরি। বিদ্যুতের লোড ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে কার্যকর করতে পারলে বছরে ১৬৫ কোটি ডলারের সমপরিমাণ তেলের দাম সাশ্রয় করা সম্ভব। বাংলাদেশের রফতানি বাজার সীমিত হওয়ায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। তারা বলছে, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় দাতাদের অর্থায়নের ওপর জোর দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আর্থিক খাতে সুশাসন বিশেষ করে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরো উন্নতি করতে হবে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ খাতে জোর দিতে হবে। এক হিসাবে বিশ্বব্যাংক জানায়, ২০১১-১৭ সাল পর্যন্ত ৪৭ শতাংশ মানুষ নতুন করে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। এ সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৮০ শতাংশ। ২০৩০ সালের বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবেলায় এখন থেকেই উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন করছে; কিন্তু এই উন্নয়ন ধরে রাখতে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। রফতানি ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি যেন কমে না যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিশ্বের ১০টি উদীয়মান দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এ জন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।

অর্থনীতিতে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রভাব ফেলবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান বলেন, সব দেশই নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে অর্থনীতির জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুবই ভালো। কিন্তু এটি সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা না করে, মান দিয়ে বিবেচনা করা উচিত।
বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, প্রবৃদ্ধিতে দু’টি বড় চিন্তার বিষয় আছে। একটি হলোÑ এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে কি না। অপরটি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির সুবিধা সবাই পাচ্ছে কি না। অর্থনীতিতে রূপান্তর আনা দরকার, কেননা বাংলাদেশে এখনো তিন কোটি ৯০ লাখ লোক দরিদ্র। তাদের মধ্যে এক কোটি ৯০ লাখ মানুষ অতি দরিদ্র। তিনি বলেন, আমরা ঝুঁকিপূর্ণ অর্থায়নের দিকে ঝুঁকেছি। পদ্মা সেতুতে ব্যয় অনেক বেড়েছে। নতুন করে যে রেলসংযোগের বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে তাও বিদেশী ঋণে।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকারি হিসাবে ৮ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেক দুর্বলতা আছে। এই দুর্বলতা নিয়ে প্রবৃদ্ধি টেকসই করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। আগে রফতানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি ছিল, এখন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদানির্ভর। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির বিতর্ককে সংখ্যার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। বিতর্কের বিষয় হওয়া উচিত গুণগত মানসম্পন্ন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কি না। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমে রাজনৈতিক সুশাসনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগামী দিনের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন হলো সংস্কার বা প্রস্তুতিকে আরো শক্তিশালী করা। সঞ্চয়পত্রে সংস্কার আনতে হবে। শুধু সুদ হার একক অঙ্কে আনলে হবে না। ভর্তুকি সঠিকভাবে সঠিক খাতে যাচ্ছে কি না তা মনিটরিং করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যে ব্যয় ধরে অনুমোদন দেয়া হয়, সেই ব্যয়ে তা শেষ করা যায় না। দফায় দফায় ব্যয় বাড়ানো হয়।


http://www.dailynayadiganta.com/first-page/353928