২ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:১০

‘সাময়িক’ শব্দে ৫ বছরে ৪০ কোটি টাকা লুটপাট!

চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগ এর কতিপয় শীর্ষ কর্মকর্তা হরিলুটে ব্যস্ত রয়েছেন। সরকারের কোটি কোটি টাকা লোকসান হলেও তারা ব্যক্তিগত লাভবান হচ্ছেন। বড় হচ্ছে সহায়-সম্পদের পাহাড়। এর অন্যতম চট্টগ্রাম পোর্ট এক্সেস রোডের টোল। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান না করে নিজেরাই টোল আদায় করছেন। ‘সাময়িক’ এর কুট-কৌশলে চলে গেছে ৫ বছর। টোল আদায়ের নামেমাত্র টাকা রাজস্ব খাতে জমা দিয়ে সিংহভাগ টাকা নিজেদের পকেটে নিয়েছে। যার পরিমান আনুমানিক ৪০ কোটি টাকা!

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের অধীন পোর্ট এক্সেস রোডের টোল আদায়ের কার্যক্রম ওএন্ডএম (অপারেশন এন্ড মেন্টেইনেন্স) পদ্ধতিতে টোল আদায় করার জন্য ২০০৮ সালের ১৬ অক্টোবর ‘মনিকো-এটিটি কনসর্টিয়াম’ কে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। যার মেয়াদ শেষ হয় ২০১৩ সালের ১৫ অক্টোবর। তৎপরবর্তীতে মামলা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ‘সাময়িক’ মাশুল আদায়ের কার্যক্রম শুরু করে সড়ক বিভাগ চট্টগ্রাম। কিন্তু কাগজে কলমে চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগ মাশুল আদায় করছে দেখালেও, বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাময়িক মাশুল আদায় কার্যক্রমে চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়িত্ব দেয়া হয়নি! সড়ক বিভাগের শীর্ষ ব্যক্তির ইচ্ছা নির্ভর বেসরকারি লোক দিয়ে চলছে টোল আদায় কার্যক্রম। যে সব বেসরকারি লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের নিয়োগ বা দায়িত্ব প্রদানের কোন সরকারি অনুমোদন নেই। মাশুল আদায়ের সাথে জড়িত লোকজনের কোন বেতন ভাতাও নেই! বর্তমানে টোল আদায়ের দায়িত্বে রয়েছেন রাজু আহমেদ। তিনি পূর্বের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘মনিকো-এটিটি কনসর্টিয়াম’র ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে টোল আদায় কার্যক্রমে ২২ জন লোক কর্মরত রয়েছেন। তাদের বেতন-ভাতা মাষ্টার রোলে পরিশোধ করা হয় বলে তিনি জানান।

অভিযোগের তীর চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমেদ এর দিকে। অভিযোগ আছে পুরো বিষয়টা আড়াল করে নিজের মনোনীত ব্যক্তিবর্গ দিয়ে টোল আদায় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তার একক সিদ্ধান্তের কারণে টোল আদায়ে সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব হারালেও কতিপয় শীর্ষ কর্মকর্তার সহায়-সম্পত্তির পাহাড় ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে।

সড়ক বিভাগের একটি সূত্র জানায়, প্রতিদিন নূন্যতম গড়ে ৬৫০০-৭৫০০ পর্যন্ত গাড়ি এ রাস্তা দিয়ে চলাচল করে যার বেশিরভাগই ট্যাঙ্কার, লরী, কাভারভ্যান, ট্রাক, পিকাপ। সেই হিসেবে এই টোল হতে দৈনিক আদায়কৃত মাশুলের পরিমাণ আনুমানিক ৪ লক্ষাধিক টাকার বেশি হলেও কার্যত গড়ে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়। চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের হিসেব অনুযায়ী অর্থ সাল ২০১৩-২০১৪ বিভাগীয় (২৭৫ দিন) এ আদায়কৃত মাশুল এর পরিমাণ দেখিয়েছেন ৩,০৭,৬৪,৫৮৯ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সূত্র জানিয়েছেন বাস্তবে কমপক্ষে ১২-১৩ কোটি টাকার মাশুল আদায় হয়েছে। সে হিসাবে সরকার ১০ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ২০১৪-২০১৫ সালে আদায়কৃত মাশুল এর পরিমাণ দেখিয়েছেন ৪,১৮,৯৯,০০০ টাকা এবং ২০১৬-২০১৭ সালে আদায়কৃত মাশুল এর পরিমাণ দেখিয়েছেন ৪,২১,৮১,০০০ টাকা। ২০১৪-২০১৫ ও ২০১৬-২০১৭ সালে সরকার অন্তত: ৩০ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয়েছে এমন অভিযোগ আছে। যার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক ও জনপদ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. সালাউদ্দিন বাংলাদেশ সড়ক ও জনপদ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন আরেকটি অংশের সভাপতি মানিক হোসেন এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা উভয়ে তেমন কিছু জানেন না বলে জানান। চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমদ জানান, পূর্বের টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠান ‘মনিকো-এটিটি কনসর্টিয়াম’ এর মেয়াদ ২০১৩ সালে শেষ হয়েছে। তাদের মেয়াদ শেষ ও বিভিন্ন জটিলতা পরিপেক্ষিতে বর্তমানে চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের তত্ত্বাবধানে টোল আদায় করা হচ্ছে। টোল আদায়ে কোন অনিয়ম-দূর্নীতি হচ্ছে না দাবি করে তিনি আরো জানান, ছয়মাস আগে দরপত্র হয়েছে। এটি মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মার্গানেট ওয়ান লিমিটেড এর সিইও সৈয়দ আহমদ ফারুক জানান, অপারেশন এবং মেইনটেন্যান্স সিস্টেম অনুযায়ী আমরা দরপত্রে অংশগ্রহন করি। সর্বনিম্ম দরদাতা ২ কোটি ৮৯ লক্ষ ২০ হাজার টাকায় আমরা টোল আদায়ের কাজ পাই। পরবর্তীতে মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে টোল আদায়ের কাজ বন্ধ করে রাখা হয়। সড়ক ও জনপথের নিজস্ব লোক দিয়ে টোল আদায় না করে অঘোষিতভাবে পূর্বের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ‘মনিকো-এটিটি কনসর্টিয়াম’র লোক দিয়ে কার্যক্রম চলাচ্ছেন নির্বাহী প্রকৌশলী জুলফিকার আহমদ। তার অভিযোগ, ২০১৪ সালের ‘টোল নীতিমালা’য় ১৪ ধারা সংযুক্ত করে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবলের মাধ্যমে টোল আদায়ের বিষয়টি আইনসিদ্ধ করে নেন। অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে ‘মনিকো-এটিটি কনসর্টিয়াম’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহবুব কবিরের অফিসে যোগাযোগ করেও তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

http://www.dailysangram.com/post/347645