২ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ১০:০১

সংকট উত্তরণে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বিকল্প নেই

একতাই শক্তি, একতাই বল, একতার উত্থান, বিভেদে পতন। বাংলা প্রবচনের একথাগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার, গোষ্ঠী, পাড়া, গ্রাম এলাকায় অহরহ এদেশের মানুষ ঐক্য সংহতির এই প্রবচনগুলোর অনুশীলন করে থাকে। এই অনুশীলন যেমন ভাল কাজের জন্য হচ্ছে, তেমনি খারাপ কাজ প্রাধান্য বিস্তার বা মারামারিতেও হচ্ছে। যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কিছু কিছু গ্রাম যেখানে গোষ্ঠী ও পাড়াভিত্তিক স্বার্থ ও ঐতিহ্য রক্ষার্থে গ্রামভিত্তিক ঐক্য গঠিত হয়ে প্রায়শঃই এক গ্রাম অন্য গ্রামের সাথে ঝগড়া-ঝাটি ও মারামারিতে লিপ্ত হতে দেখা যায়। একটি নির্দিষ্ট ভূগৌলিক অঞ্চল ও জনসংখ্যা নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়। রাষ্ট্রের ভূগৌলিক অখ-তা রক্ষা, জনগণের স্বার্থ বিশেষ করে তাদের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সুশাসন নিশ্চিতকরণ, সকল প্রকার বঞ্চনার অবসান, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, সন্ত্রাস, অবিচার, অত্যাচার, চাঁদাবাজি প্রভৃতি রোধ এবং নির্দিষ্ট মেয়াদে জনগণকে সরকার নির্বাচনে নিরপেক্ষ এবং দলীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত কর্তৃপক্ষের অধীনে ভোটাধিকার প্রয়োগের অবাধ সুযোগ প্রদান প্রভৃতি বিষয়ে ধর্ম-বর্ণ ও দলমত নির্বিশেষে জনগণের যে ঐক্য তাই হচ্ছে জাতীয় ঐক্য। ঐক্য ছাড়া কোনও জাতি টিকে থাকতে পারে না। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি জাতির উন্নয়ন এবং বৈষম্য দূরীকরণেরও রক্ষাকবচ। এই ঐক্য ও সংহতি নিছক নির্বাচন বা ভোট কেন্দ্রিক জোট নয়। জোট ঐক্য কাঠামোরই অংশ। পাঠকদের হয়তো মনে আছে যে, ২০১৬ সালে তুরস্কে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল, তাতে তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে হত্যার ষড়যন্ত্রও ছিল। তিনি এত্থেকে রক্ষা পান এবং দেশবাসীকে অভ্যুত্থান প্রতিরোধের জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান। তার আহ্বানে সে দেশের কোটি কোটি মানুষ ঘুম নিদ ছেড়ে গভীর রাতে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। এটা জাতীয় ঐক্য। যারা রাস্তায় নেমেছিলেন তারা সবাই এরদোগানের দল একে পার্টির সদস্য ছিলেন না, তাদের মধ্যে এ দলের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থক বা সদস্যও ছিলেন। তারা দেশকে ভালবাসেন, গণতন্ত্রকে ভালবাসেন। দেশ এবং গণতন্ত্র থাকলে ক্ষমতায় গিয়ে নিজের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার সুযোগ আসবে আজ হোক বা কাল। ঐক্য চিন্তায় এটাই হচ্ছে মৌলিক পদ্ধতি এবং আমি ইতোপূর্বে যে মৌলিক বিষয়গুলোর কথা বলেছি সেগুলো ঐক্যের মৌলিক উপাদান। কোনও প্রকার বিভক্তি রেখা টেনে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না। দক্ষিণ এশিয়ার যে অঞ্চল ও পরিবেশে বাংলাদেশের অবস্থান তাতে আমাদের টিকে থাকা এবং অগ্রগতি সমৃদ্ধির জন্য জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুখের বিষয় যে, কিছুদিন আগে আমাদের কিছু সিনিয়র রাজনীতিবিদ ও অভিজ্ঞ নেতা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছেন, কিন্তু ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রত্যাশিত টার্গেটে পৌঁছতে পারেননি বলে মনে হয়। তাদের ইচ্ছা-অভিপ্রায়ে ঘাটতি না থাকলেও কারোর কারোর ব্যক্তিগত ও দলীয় সংকীর্ণতা অথবা ঐক্য সম্পর্কিত সঠিক ধারণার অভাব এর জন্য সম্ভবত দায়ী। বিএনপি এবং তার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সাথে ঐক্য করতে গিয়ে তাদের কেউ কেউ ২০ দলের অন্যতম প্রধান ও সক্রিয় শরিক দল জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে ঐক্য প্রক্রিয়ায় শরিক হবার জন্য বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। এ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় ও টকশোতে আলোচনার ঝড় উঠেছে। ঐক্যের উদ্যোক্তাদেরই আবার কেউ কেউ আসন্ন নির্বাচনে আসন ভাগাভাগি ও নির্বাচন-উত্তর সরকার গঠনের পর কে কত বছর সরকার পরিচালনা করবেন এবং কাকে কোন মন্ত্রণালয় দেয়া হবে তা নিয়েও দরকষাকষি করছেন। এগুলো ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার শর্ত হতে পারে না বলে আমি মনে করি। এগুলো নির্বাচনী জোটেরই বিষয়। দুটি জিনিসকে তারা গুলিয়ে ফেলেছেন। এমনও হতে পারে যে যেহেতু সামনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই তারা ঐক্য প্রক্রিয়া শুরু করেছেন সেহেতু ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলার জন্য তারা সমন্বিতভাবে বিষয়টি দেখছেন। তাদের উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য।

আসন্ন নির্বাচনকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও নির্বিঘ্ন করার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই, একথাটি অস্বীকার করা যাবে না। তবে আমি এদিকে আসছি না। আমি আজ ঐক্য নিয়েই কথা বলছি এবং রাজনীতির একজন ছাত্র হিসেবে গত প্রায় ৫ দশকের অধ্যয়নের আলোকে জামায়াত সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। এটি ঐক্য প্রক্রিয়ায় জামায়াতের অন্তর্ভুক্তিতে যাদের এলার্জি আছে তাদের জন্য।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জাতীয় ঐক্যকে পরিহাস করে বলেছেন যে, আওয়ামী লীগকে ছাড়া জাতীয় ঐক্য হতে পারে না। তার সাথে আমি একমত। আওয়ামী লীগ জাতির অংশ। তাদের বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ঐক্য হতে পারে না। তেমনি জামায়াত যেহেতু জাতির একটা অংশ সেহেতু তাকে বাদ দিয়েও ঐক্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে না।
আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও অগ্রগতি-সমৃদ্ধির জন্য জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় দল হিসাবে এই ঐক্য প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগই উদ্যোক্তার ভূমিকা পালন করতে পারতো। কিন্তু তা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এই দলটির নেতৃবৃন্দ শুরু থেকেই ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজনকেই বেছে নিয়েছে। একইভাবে তারা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার ও সুশাসনের পক্ষ শক্তি হিসেবেও নিজেদের পরিচয় দিতে পারেনি। এখন যদি তারা ঐক্যের অংশিদার হতে চায় তাহলে ঐক্যের উপাদানগুলোকে গ্রহণ করেই তাদের এদিকে এগিয়ে আসতে হবে। আগের মত হাত জোড় করে মাফ না চাইলেও চলতে পারে।

আমি বলছিলাম স্বাধীনতার প্রথম লগ্ন থেকেই দেশকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এই বিভক্তির অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে আওয়ামী লীগ। বলা বাহুল্য, ১৯৭২-৭৩ সালেও স্বাধীনতার অব্যবহিত পর এই বিভক্তির চেষ্টা করা হয়েছিল। তা বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। এই বিভাজনের ভিত্তি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা না করা এবং রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা হওয়া না হওয়া। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ মনে করে যে তারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন। কাজেই অন্যেরা সকলেই স্বাধীনতা বিরোধী। এ কথা সত্য যে, ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর হামলার প্রেক্ষাপটে লক্ষ লক্ষ লোকের ভারতে আশ্রয় প্রার্থনা ও ভারতীয় নেতৃত্বে মুক্তি ফৌজ গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ, সেনাবাহিনী কর্তৃক সিভিলিয়ান সরকার প্রতিষ্ঠা, রাজাকারবাহিনী গঠন প্রভৃতি নিয়ে দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যে বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়েছিল তাতে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। এই মন্ত্রী সভায় সকল দলের দু’জন প্রতিনিধি থাকলেও আওয়ামী লীগের ছিল তিন জন, ওবায়দুল্লাহ মজুমদার, সামছুল হক এবং জসিম উদ্দিন। এদের মধ্যে প্রথম দু’জন এমএনএ ছিলেন।
প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর এই সময়টা ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের জন্য মহাসংকটকাল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রদেশব্যাপী যে অসহযোগ, হরতাল, অবরোধ, অগ্নি সংযোগ, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য এবং অবাঙ্গালী জনপদের উপর যে অত্যাচার-অবিচার শুরু হয়েছিল তার প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান আর্মীর নির্মম ক্র্যাকডাউন সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে এনে দিয়েছিল অমানিশার অন্ধকার। তাদের জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও নিরাপত্তা ছিল না। যখন তখন গ্রেফতার, পাশবিক ও দৈহিক অত্যাচার এবং নির্যাতন পরিণত হয়েছিল নিত্যদিনের ভাগ্যলিপি। এই সময়টি ছিল দেশপ্রেমিকদের পরীক্ষা দেয়ার প্রকৃষ্ট সময়। সীমান্তপারে ভারত ভূখন্ডে আশ্রয়প্রার্থী ৭৫.৫৬ লক্ষ শরণার্থী ব্যতীত বাকী ৭ কোটি বাঙ্গালী ছিল কার্যত সশস্ত্র হিংস্র পাক বাহিনীর হাতে বন্দী। এরা পাক বাহিনীর জুলুম সহ্য করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের আহার, আশ্রয় এবং অন্যান্য সহযোগিতা দিয়েছে। তারা আত্মত্যাগ করেছে, স্বজন হারিয়েছে, কিন্তু আত্মসমর্পণ করেনি। ভারতপন্থী দলগুলো ছাড়া অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীরা তাদের সাহস জুগিয়েছে; পাক বাহিনীর হাত থেকে তাদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। পক্ষান্তরে ভারতপন্থী দলগুলোর নেতা-নেত্রীরা দেশবাসীকে তোপের মুখে ঠেলে দিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত Bangladesh Documents অনুযায়ী তাদের সাথে সে দেশে প্রাণ ভয়ে শরণার্থী হয়েছিল ৭৫.৫৬ লক্ষ লোক, সাম্প্রদায়িক বিভাজন অনুযায়ী যাদের মধ্যে ছিল ৬৯.৭১ লক্ষ হিন্দু, ৫.৪১ লক্ষ মুসলিম এবং ০.৪৪ লক্ষ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী লোক। প্রবীণ রাজনীতিবিদ জাতীয় লীগ প্রধান অলি আহাদের ভাষায়, “ভাগ্যের কি পরিহাস, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর এদেশের মৃত্যুঞ্জয়ী সাত কোটি মানুষ মুহূর্তের মধ্যে ভারতের আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থীদের দৃষ্টিতে পাক বাহিনীর সহযোগী রূপে অভিযুক্ত হয় এবং এক পলকে পরিণত হয় এক অচ্ছ্যুত শ্রেণীতে। আরো পরিতাপের বিষয় ১৬ ডিসেম্বরের পরে অনুষ্ঠিত অত্যাচার, অবিচার, লুটপাট, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ-নির্যাতন ১৬ ডিসেম্বরের আগেকার মতই সমভাবে শহর নগর গ্রামের বাঙ্গালী জীবনকে বিষাক্ত করে তোলে। ভারত প্রত্যাগত মুষ্টিমেয় শরণার্থী ছিল এর জন্য দায়ী।’’ দেশপ্রেমের দলীয়করণ এ ক্ষেত্রে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলকে ভারসাম্যহীন করে তোলে এবং তারা সারা জাতিকে স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ এই দুটি শক্তিতে বিভক্ত করে নেয়। আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরোধিতা এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারকেও রাজাকারে পরিণত করে- (যেমন মেজর জলিল) দেশপ্রেম একটি বিশেষ দলের পৈত্রিক সম্পত্তি হয়ে দাঁড়ায়। কাগজে কলমে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পেলেও কার্যত তা ভারতের বশংবদ রাষ্ট্রে পরিণত হয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।
বলাবাহুল্য, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারতে অবস্থানকালে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহযোগিতার বিনিময়ে ভারত সরকারের সাথে সাতটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। এই চুক্তিগুলোর বিষয়বস্তু ছিল নিসম্নরূপঃ
১) ভারতীয় সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করা হবে। গুরুত্বের দিক থেকে এবং অস্ত্র-শস্ত্র এবং সংখ্যায় এই বাহিনী মূল সামরিক বাহিনী থেকে বড় এবং তাৎপর্যপূর্ণ হবে (যেমন, রক্ষী বাহিনী)।
২) ভারত থেকে সমরোপকরণ এবং অস্ত্র-শস্ত্র ক্রয় করতে হবে এবং ভারতীয় সমরবিদদের পরামর্শের ভিত্তিতে তা করতে হবে।
৩) ভারতীয় পরামর্শেই বাংলাদেশের বহিঃবাণিজ্য কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হবে।
৪) ভারতীয় পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
৫) বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির অনুরূপ হবে।
৬) ভারতের সম্মতি ছাড়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত কোনও চুক্তি বাতিল করা যাবে না।
৭) ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত যে কোনও সময় যে কোন সংখ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং এ ব্যাপারে বাধাদানকারী শক্তিকে চুরমার করে দেয়ার অধিকার তার থাকবে।

উপরোক্ত চুক্তিগুলো প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ স্বাক্ষর করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই সাতটি চুক্তি ঈষৎ পরিমার্জিত রূপে ১৯৭২ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকার বুকে বঙ্গভবনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত ২৫ সালা ‘বন্ধুত্ব সহযোগিতা ও শান্তি’ চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দেশের সকল রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করেছিল। তৎকালীন সরকার দেশের স্বার্থের পরিপন্থী ও জাতিদ্রোহী অবস্থান থেকে এক চুলও নড়তে রাজী ছিল না এবং চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে পার্লামেন্টের বা বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণেরও প্রয়োজন বোধ করেনি। ২০১০ সালে জানুয়ারি মাসে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন তা জাতীয় স্বার্থের অনুকূল নয় এবং পার্লামেন্টেও তা পেশ করা হয়নি। ভারতকে মরণ বাঁধ ফারাক্কা চালুর অনুমতি প্রদান ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘৃণ্যতম কাজগুলোর অন্যতম। এই বাঁধ চালু করার ফলে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবার ঝুঁকিতে নিক্ষিপ্ত হয়। ফারাক্কায় পানি প্রত্যাহারের ফলে পদ্মা ও তার অববাহিকা অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যায়, গাছ-পালার পুষ্টি উপাদানে সংকট দেখা দেয় এবং আর্সেনিকের প্রাদুর্ভাব বিপদ সীমা অতিক্রম করে। লোনা পানির প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যায় এবং এর ফলে উপমহাদেশের অন্যতম বৃহত্তম নিউজপ্রিন্ট মিল খুলনা নিউজ প্রিন্ট মিলসহ বাংলাদেশের হাজার হাজার শিল্প ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। শীত মওসুমে পদ্মার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও গোদাগাড়ি পয়েন্টে এখন লঞ্চ, স্টীমারের পরিবর্তে গরুর গাড়ী চলে। নদী এখন চর। এখন তিস্তার পানি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।

আমি বিভক্তি বিভাজন নিয়ে কথা বলছিলাম। বাংলাদেশে মোট রাজাকারের সংখ্যা প্রায় ৫৫,০০০ ছিল। এর মধ্যে ৩৮,০০০ (প্রায়) রাজাকারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এটি ছিল একটি চাকরি। এতে জামায়াত সমর্থকের সংখ্যা ছিল আটশ’রও নিচে। আওয়ামী লীগসহ সকল দলের লোকই এই চাকরিতে যোগ দিয়েছে এবং থানার সার্কেল অফিসাররা এদের ঢোল সহরত করে নিয়োগ দিয়েছে। সরকারি দফতরে তাদের রেকর্ড আছে। কাজেই পাইকারী হারে সবাইকে রাজাকার বলা এবং এই অজুহাতে নির্দলীয় ছেলে-মেয়েদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করা সম্পূর্ণভাবে একটি অনৈতিক কাজ। আওয়ামী লীগ না করলে কেউ দেশ প্রেমিক হবেন না তা নয়। এই দেশের প্রত্যেকটি নাগরিক দেশপ্রেমিক, তারা খাজনা দেন এবং দেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র তাদের মৌলিক অধিকারসমূহ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রয়োজন। বিভক্তি দিয়ে এই ঐক্য সংহতি হতে পারে না। জামায়াত রাজাকারের দল নয়।

জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী একটি দল। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জামায়াতের কোন নেতাকর্মী ভারতে পালিয়ে যায়নি। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যকোন দলের নেতকার্মী যারা সেখানে গিয়েছিলেন তাদের কেউ সেখানে স্থান পায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যের ভয়ে অনেকেই তখন স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। তারা এ দেশে থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করেছেন। জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এ কথা দেশবাসী বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশ গঠিত হবার পর থেকে প্রত্যেকটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াত অংশগ্রহণ করেছে। সংকটে, সুখে দুঃখে জামায়াতকে মানুষের পাশে থেকে মানুষের খেদমত করতে দেখা গেছে। রাজনৈতিক শিষ্টাচার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সততা-নিষ্ঠা এবং শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও শৃঙ্খলার অনুশীলনে তারা অনুপম দৃষ্টান্ত রেখেছে। জামায়াত ও অন্যান্য দলের উপর পরিচালিত অধ্যাপিকা রওনক জাহানের গবেষণাকর্মটি আমি সবাইকে পড়ে দেখার জন্য অনুরোধ করবো। চারদলীয় জোটের মন্ত্রী সভায় জামায়াতের দু’জন প্রতিনিধি ছিলেন। তারা যোগ্যতা ও সততা-নিষ্ঠার যে পরিচয় দিয়েছেন বাংলাদেশের ইতিহাসে তা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। জামায়াতের বিরুদ্ধে যত অত্যাচার নিপীড়ন ও অপপ্রচার হচ্ছে তার জনপ্রিয়তা ততই বাড়ছে। বিগত নির্বাচনসমূহই তার প্রমাণ।

২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ৩৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩২,৮৬,৪৫৯ ভোট পেয়েছে। ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনে বিভিন্ন পদে ৩০৯ উপজেলার প্রতিদ্বন্দি¦তা করে ১ কোটি ১৯ লক্ষ ৯২ হাজার ১২৯ ভোট পেয়েছে। এর মধ্যে ১১৩টি চেয়ারম্যান পদে পেয়েছে ৩৮,২১,৭০৭ ভোট। ২৪৬টি পুরুষ ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী পেয়েছেন ৯৫,৫২,২৬৪ ভোট এবং ৭৫টি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ প্রার্থীরা পেয়েছেন ৩০,৪৭,৩৭২ ভোট। প্রার্থীদের মধ্যে ৩৬ জন চেয়ারম্যান, ১২৯ জন ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ) এবং ৩৬ জন ভাইস চেয়ারম্যান (মহিলা) বিজয়ী হয়েছেন। ১৯১১ সালে জামায়াতের সাথে বিএনপি বা অন্যকোন দলের জোট ছিল না। ঐ সময় তারা জাতীয় নির্বাচনে ১৮ জন এমপি পেয়েছিলেন। ২০০১ সালের পার্লামেন্টেও জামায়াতের ১৭ জন এমপি ছিলেন। জামায়াত নির্বাচিত কিছু আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে এবং এই অবস্থানে এসেছে। সারা দেশের প্রত্যেকটি গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলায় তাদের সংগঠন আছে। দেশবাসী তাদের চেনে এবং তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিশ্বাস করে না।

বাংলাদেশ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। মানবাধিকার পদদলিত হচ্ছে। দেশে সুশাসন নেই। মানুষের উপর ত্যাচার অবিচার সীমা অতিক্রম করেছে। গণতন্ত্রের স্থলে নির্মম স্বৈরাচার জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে। দুর্নীতি স্বজন ও দলপ্রীতি আমাদের ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। এ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। অবিলম্বে ঐক্য প্রক্রিয়া শেষ করে দেশকে উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/347662