১ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ১০:৩০

৮ ঘণ্টা অচল দেশের সব বিমানবন্দর

এমডির আশ্বাসে শ্রমিকদের কাজে যোগদান * লাগেজ না পেয়ে যাত্রীদের চিৎকার, হইচই * লাগেজ হ্যান্ডলিং করেন সিভিল এভিয়েশনের অ্যাবসেক সেল ও আনসার সদস্যরা

বারবার আশ্বাসের পরও চাকরি স্থায়ী না করায় বিক্ষুব্ধ ক্যাজুয়াল (অস্থায়ী) শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে রোববার ৮ ঘণ্টা প্রায় অচল ছিল দেশের সব বিমানবন্দর। বিলম্বিত হয় বেশ কয়েকটি ফ্লাইট। ভোগান্তির শিকার হন যাত্রীরা। সকাল ৮টায় কর্মবিরতিতে যান অস্থায়ী শ্রমিকরা। পরে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দাবি মানার আশ্বাসে বিকাল ৪টায় শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন।
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে সকালে কর্মবিরতি শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি সামাল দিতে বিমানের গ্রাউন্ড সার্ভিসের দায়িত্ব পালন করেন সিভিল এভিয়েশনের অ্যাবসেক সেল ও আনসার সদস্যরা। চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরসহ দেশের অন্য বিমানবন্দরগুলোতেও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময় পরিস্থিতি সামাল দেয় সিভিল এভিয়েশন।

শাহজালালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে টনক নড়ে বিমান কর্তৃপক্ষের। বেলা ৩টায় বিমানের সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমানের সঙ্গে বৈঠক করে দাবি মানার আশ্বাস দেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্যাপ্টেন এএম মোসাদ্দেক আহমেদ। তিনি শ্রমিকদের সামনে ঘোষণা দেন, আমরা সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। আগামী বোর্ড মিটিংয়ে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করার বিষয়টি উপস্থাপন করা হবে। এ সময় বিমান শ্রমিক লীগের সভাপতি মশিকুর রহমান পাল্টা হুমকি দিয়ে বলেন, আগামী বোর্ড মিটিংয়ে যদি দাবি না আদায় হয় তবে বিমানের সিবিএ নেতাকর্মীসহ ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা আবারও কর্মবিরতিতে যাবেন।
এরপর বিকাল ৪টা থেকে ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা কাজে যোগ দিতে শুরু করেন। শ্রমিকরা বলছেন, এর আগে বিমানমন্ত্রী দু’দিনের সময় নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সাড়া মেলেনি। এ জন্য শ্রমিকরা নন, ম্যানেজমেন্ট দায়ী।

জানা গেছে, পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সকাল ৮টায় পালা বদলের সময় শাহজালালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও বিএফসিসিতে কর্মরত ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা এডমিন ভবনের গেটে জড়ো হতে থাকেন। এ দুটো শাখার শ্রমিকের ৮০ ভাগই ক্যাজুয়াল হওয়ায় ফাঁকা হয়ে পড়ে তাদের কর্মস্থল। প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক একযোগে প্রথমে বিমান শ্রমিক লীগ ও সিবিএ অফিসে যান। সেখানে সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমানকে ঘেরাও করেন। এ সময় অস্থায়ী শ্রমিকদের নেতা মোহাম্মদ হানিফ ঘোষণা দেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করব। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বলাকা ভবন ঘেরাও করব। ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাব। ঘেরাওয়ের খবর পেয়ে বিমানবন্দর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ হাজির হয়ে মশিকুর রহমানকে উদ্ধার করেন। এরপর হানিফের নেতৃত্বে একটি মিছিল সিবিএ কার্যালয় থেকে বিক্ষোভ করে বলাকা ভবনের সামনে এসে অবস্থান নেয়। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করবেন বলে ঘোষণা দেন।

এদিকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সব ক্যাজুয়াল শ্রমিক কর্মসূচিতে যোগ দেয়ায় ভেঙে পড়ে বিমানের গ্রাহকসেবা। বিপর্যয় দেখা দেয় ফ্লাইট সিডিউলে। হাতে গোনা ২০-২৫ স্থায়ী কর্মচারী চেকইন কাউন্টার, বেল্ট এরিয়া ও অ্যাপ্রোন এলাকায় কাজ করছিলেন। এ সময় লাগেজ না পেয়ে যাত্রীরা হইচই শুরু করেন। দীর্ঘক্ষণ চেকইন লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে সেবা না পাওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তারা। একইভাবে নিচে কনভেয়র বেল্ট এরিয়ায় কয়েকশ’ যাত্রীর লাগেজ না আসায় মারমুখী হয়ে ওঠেন।
তাৎক্ষণিক বিষয়টি সিভিল এভিয়েশন সদর দফতরে জানান বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফারুক আবদুল্লাহ। সঙ্গে সঙ্গে শাহজালালে ছুটে আসেন সিভিল এভিয়েশনের সদস্য এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি কর্মরত অ্যাবসেক, এপিবিএন, আনসার সদস্যদের জরুরিভাবে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজে যোগ দিতে নির্দেশ দেন। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে তিনি বিমানবন্দরের সব অপারেশনাল কাজ নিজেই তদারক করতে থাকেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় অ্যাপ্রোন এলাকায় গিয়ে দেখা যায় পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন ফারুক আবদুল্লাহ, উইং কমান্ডার নুর-ই-আলম সিদ্দিকী ও উপ-পরিচালক বেনী মাধব বিশ্বাসের উপস্থিতিতে ৬০-৭০ জন নিরাপত্তাকর্মী অ্যারাইভাল লাগেজের কাজে ব্যস্ত। সেখানে ছুটে যান এয়ার কমোডর মোস্তাফিজুর রহমান। টানা ৬ ঘণ্টা তিনি সেখানে কাজের সমন্বয় করেন।

এদিকে শ্রমিকদের কর্মবিরতিতে ফ্লাইট সিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সিঙ্গাপুরগামী বিজি-০৮৪ ফ্লাইটটি সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও, সেটি সকাল ৯টা ৪ মিনিটে ছেড়ে যায়। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের কুয়ালালামপুরগামী বিএস-৩১৫ ফ্লাইটটি সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ছেড়ে যায় ৯টা ১০ মিনিটে। এয়ার এরাবিয়ার শারজাহগামী জি-৯৫১৮ ফ্লাইটটি সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও সেটি ছেড়ে যায় সকাল ১০টার দিকে। এমিরেটসের দুবাইগামী ইকে-৫৮৩ ফ্লাইটটি ১০টা ১৫ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও বেলা ১১টা ৩২ মিনিটে ছেড়ে যায়। এ ছাড়াও অন্য এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটগুলো নির্ধারিত সময়ে ছাড়তে পারেনি। এ সময় বিমানের জিএম নুরুল ইসলাম হাওলাদার ও জিএম কাস্টমার সার্ভিস আতিক সোবহান ছাড়া অন্য কোনো কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি। জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, সকালের দিকে কয়েকটি ফ্লাইটের সিডিউল বিপর্যয় ছিল। ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা না থাকলেও এপিবিএন দিয়ে কাজ করেছি। দুপুরের পর সিভিল এভিয়েশনও কাজে যোগ দেয়।

অবস্থা বেগতিক দেখে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দিক আহমেদ, সিবিএ সভাপতি মশিকুর রহমান ও ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফকে নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন। ত্রিপক্ষীয় আলোচনার সময় এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রীর সঙ্গে। তাদের সঙ্গে পরামর্শের পর বিমান এমডি জানান, পরবর্তী বোর্ড মিটিংয়ে ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করার বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এরপর শ্রমিকরা তাদের কর্মবিরতি স্থগিত করেন।

উল্লেখ্য গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সভায় বিমানের ৭০০ ক্যাজুয়াল পে গ্রুপ (৩১) ও (৩২) তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তার চাকরি স্থায়ীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের (পে গ্রুপ ১) ১৮০০ জনের চাকরি স্থায়ী করার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এরপর ক্যাজুয়াল শ্রমিকরা ২৪ সেপ্টেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন বিমানমন্ত্রী দু’দিনের সময় চেয়ে আশ্বাস দেন, দাবি মানা না হলে শ্রমিকদের আন্দোলনে তিনিও সমর্থন দেবেন। কিন্তু তিনিও কিছু করেননি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/95985