৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:০৯

গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে গায়েবি বিলের ছড়াছড়ি, ৪০ কোটি টাকার বিল জব্দ

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রকল্পে গায়েবি বিলের খোঁজ মিলেছে। কাজ হয়নি অথচ কোম্পানির প্যাডে স্বাক্ষর করে বিল তুলে নিয়েছেন ঠিকাদাররা। প্রকৌশলীদের সঙ্গে যোগসাজশে এমন অপকর্ম করেছেন তারা। বিল দেয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিল প্রস্তুতের মাপবহি (এমবি)-তেও কোনো তথ্য এন্ট্রি নেই। গেল ছয় বছরের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলের তথ্য যাচাই করতে গিয়ে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির নতুন চেয়ারম্যান মো. রাশেদুল ইসলাম ঠিকাদারি বিলগুলো দেখে রীতিমতো হতবাক। প্রতিষ্ঠানটির সদস্যদের সামনে তিনি বলেছেন, এভাবেও কি সরকারি অর্থ গায়েব করে দেয়া যায়। কাজ হয়নি অথচ কোটি কোটি টাকা খেয়ে ফেলা হয়েছে।
এটা মেনে নেয়া যায় না। নতুন চেয়ারম্যানের এমন মনোভাব জানতে পেরে গায়েবি বিলের তথ্য ধামচাপা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে প্রকৌশল শাখার একটি শক্তিশালী চক্র। মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা ওই চক্রের অভিভাবকের ভূমিকায় রয়েছেন। এ জন্য চক্রটি প্রচার করছেন সহসাই বদলি হয়ে যাবেন চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মো. রাশেদুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, সদ্য যোগদান করে সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি। কোনো তথ্য জানতে চাইলে সাক্ষাৎ করে জেনে নিতে হবে। টেলিফোনে কোনো কথা বলতে পারবো না। অফিসে আসেন, কথা বলি। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যান পদে যোগদানের পর থেকে নিজ প্রতিষ্ঠানের অধীন বিভিন্ন ডিভিশনের অফিস পরিদর্শনে যাচ্ছেন গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বর্তমান চেয়ারম্যান। গত কয়েক দিনে মিরপুরের বিভিন্ন প্রকল্প ও ঢাকার বাইরের প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছেন তিনি। মিরপুরে নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর ও সাইট অফিস পরিদর্শনে গিয়ে চোখ যেন কপালে উঠে চেয়ারম্যানের। তিনি জানতে পারেন প্রতিষ্ঠানটির মিরপুর এলাকায় বাস্তবায়নাধীন স্বপ্ননগর ও জয়নগর, চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ ও রাউজানসহ বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পের বিপরীতে কোটি কোটি টাকা ভুতুড়ে বিল জমা দিয়ে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।

এ ছাড়া বাস্তবায়নাধীন বিভিন্ন ফ্ল্যাট প্রকল্পের প্রাক্কলন বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি তৈরি করা হয়েছে। এসব তথ্য জানার পর প্রকল্পগুলোর বিপরীতে দেয়া ছয় বছরের বিলের তথ্য চেয়ে পাঠান গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান। বিভিন্ন প্রকৌশল শাখা থেকে বিল আসার পর এরই মধ্যে ৪০ কোটি টাকার বিল জব্দ করেছে চেয়ারম্যান দপ্তর। এ বিলটি কাজ না করেই দিয়ে দেয়া হয়েছে ঠিকাদারকে। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মিরপুর নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ‘সিবিএল’ নামের একটি কোম্পানি বিল জমা দিয়ে ৩০ কোটি টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন। প্রকৌশল শাখার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে নির্বাহী প্রকৌশলী মুনিফ আহমেদ নিজ বিবেচনায় এ বিল দিয়ে দিয়েছেন। এজন্য এমবিতে কোনো ধরনের এন্ট্রি করা হয়নি। যদিও সিভিল কাজের বিল দেয়ার নিয়ম অনুযায়ী কোনো ঠিকাদার বিল নিতে গেলে প্রকৌশল শাখার নির্ধারিত এমবিতে এন্ট্রি থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ৩০ কোটি টাকার বিল নেয়ায় এ ধরনের কোনো এন্ট্রি নেই।

এ বিষয়ে প্রকৌশলী মুনিফ আহমেদ তার ঘনিষ্ঠজনদের জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশের কারণে তিনি পেরে উঠছেন না। চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত এক সিনিয়র কর্মকর্তার কারণে তাকে বাধ্য হয়ে গায়েবি বিলে স্বাক্ষর করতে হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ‘সিবিএল’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েই এটি বিক্রি করে দেন। এর ফাঁকে ঠিকাদার বিলটি তুলে নিয়ে যান। ফলে বিপদে পড়ে যায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। এখন প্রকৌশল শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিলটি জায়েজ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে মিরপুরের বিভিন্ন ফ্ল্যাট প্রকল্পের বিপরীতে চার হাজার কোটি টাকার টেন্ডার হয়েছে। পার্সেন্টেজ ছাড়া এসব টেন্ডার প্রক্রিয়া করা হয়নি।

বেশি দর দেখিয়ে অনেক টেন্ডার প্রক্রিয়াকরণ করা হয়েছে। প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া করার কারণে প্রতিটি ফ্ল্যাটের বর্গফুট প্রতিমূল্য ২০% থেকে ৩০% বেড়ে গেছে। এদিকে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ‘স্বপ্ন নগর’ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের ১০টি বহুতল ভবনে ৮৭৮ বর্গফুট, ১৩৩৮ বর্গফুট ও ১৫৪৫ বর্গফুট আয়তনের মোট ১০৪০টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হয়েছে। গেল বছরের ১লা মার্চ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন মিরপুর ৯ নং সেকশনে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নির্মাণাধীন ‘স্বপ্ন নগর’ অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্প পরিদর্শনকালে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজের গুণগত মান নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। এরপর থেকে অজানা কারণে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কোনো কর্মকর্তা প্রকল্পগুলো নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। তবে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষে নতুন চেয়ারম্যান যোগদানের পর ডিভিশনগুলোতে পরিদর্শন করছেন। নানা অনিয়ম ধরছেন।

ফলে প্রকৌশল শাখা এখন কিছুটা তটস্থ। বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন, এভাবে চলতে থাকলে চেয়ারম্যান পদে বেশিদিন থাকতে পারবেন না রাশেদুল ইসলাম। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যান রাশেদুলও দমে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি তার পরিদর্শন ও অনিয়ম ধরার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।

http://mzamin.com/article.php?mzamin=137973