৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ১০:০১

ফেরিঘাটে ভোগান্তি

রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে রাত সাড়ে ৭টায় বরিশাল এক্সপ্রেস পরিবহনের গাড়িটি ছেড়ে যখন শিমুলিয়া ঘাটে পৌঁছায় তখন রাত পৌনে ৯টা। পথে দোলাইরপাড় থেকে পোস্তগোলা ব্রিজ পর্যন্ত বেশ দুর্ভোগে পড়তে হয় যাত্রীদের। শিমুলিয়া ঘাটে পৌঁছার পরে পোস্তগোলার কান্তি অনেকটা ভুলেই গিয়েছিলেন যাত্রীরা। পদ্মা পার হলেইতো আর আড়াই-তিন ঘণ্টা। যাত্রীরা অনেকটা উৎফুল্ল মনেই এসব বলে যাচ্ছিলেন। বরিশাল এক্সপ্রেসের সামনে মাত্র ১২টি গাড়ি। দুইটি ফেরিতেই এই গাড়ি পার হওয়া সম্ভব।

গত রোববারের এ ঘটনা। বরিশাল এক্সপ্রেসের পেছনে এক এক করে লাইন জমে যাচ্ছে গাড়ির। কোনোটি যাত্রীবাহী বাস, কোনোটি পণ্যবাহী ট্রাক, প্রাইভেট কার, রোগীবাহী গাড়ি ইত্যাদি। যাত্রীরা কেউ কেউ গাড়ি থেকে নেমে পায়চারি করছিলেন। কেটে যেতে থাকে সময়। রাতও গভীর হতে থাকে। কিন্তু গাড়ি ফেরিতে উঠছে না। এ নিয়ে যাত্রী, বাসচালক এবং ঘাটের লোকজনের মধ্যে নানা কথা। কেউ বলছেন, প্রবল স্রোতে ফেরি ঠিকমতো চলছে না। কেউ বলছেন, চরে একটি ফেরি আটকে গেছে; যে কারণে অন্য ফেরি চলতে পারছে না। আবার কারো কারো বক্তব্য ছিল, হঠাৎ চর জেগে ওঠায় ফেরিগুলো পরিপূর্ণ হয়ে চলতে পারছে না। দুই-তিনটি করে গাড়ি বহন করছে ইত্যাদি নানা কথা। ঘাটে যে আনসার ও পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিলেন তাদেরও কেউ বলতে পারছেন না আসলে কী ঘটেছে। রাত ২টায় ঘাটে গিয়ে দেখা যায় ফেরিগুলো সব নোঙর করা। ঘাট পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো কর্মকর্তাকেও পাওয়া গেল না। তবে ঘাটে যারা ফেরি করে মালামাল বিক্রি করে তাদের কয়েকজন জানাল, সকাল হওয়ার আগে ফেরি ছাড়বে না। রাতে চ্যানেলের কোথাও কোথাও চর পড়ে যায়। ফেরি ওই সব চরে আটকে যায়। যে কারণে রাতে ফেরি চলবে না।

রাত ৯টার পরে ঘাটে লঞ্চ চলাচলও বন্ধ। আর স্পিডবোট চালানোয় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সন্ধ্যার পর থেকেই। যে কারণে যাত্রীদের ৯টার পরে আর পারাপারের সুযোগ থাকে না। যাত্রীদের অনেকে হেঁটে সময় কাটাচ্ছেন, অনেকে টং দোকানগুলোতে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। গাড়ির ভেতরে বসার সুযোগ নেই। গাড়ির ভেতরে মশার উৎপাত। আবার গাড়ির লোকজন ভেতরের ফ্যানগুলো বন্ধ করে রেখেছেন ব্যাটারি টিকিয়ে রাখার জন্য। ফ্যানগুলো চালালে ব্যাটারি ক্ষয় হবে, পরে গাড়ি আর স্টার্ট হবে না। গাড়িগুলোর ভেতরে প্রচণ্ড গরম। অল্প বয়স্করা বাইরে বের হয়ে হাঁটাহাঁটি করতে পারলেও চরম ভোগান্তির শিকার হন বৃদ্ধ এবং শিশুরা।

রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে যায়। কিন্তু ফেরি ছাড়ার কোনো খবর নেই। মানুষগুলো প্রচণ্ড বিরক্ত হলেও তাদের কিছুই করার নেই। এদের মধ্যে অনেকেরই ছিল জরুরি কাজ। হারুন ও কাশেম নামে দুইজন জানালেন তাদের আত্মীয় মারা গেছেন। সকালে নামাজে জানাজা ছিল। কিন্তু ফেরির কারণে জানাজায় অংশ নেয়া সম্ভব হলো না। অনেকের আত্মীয়স্বজন অসুস্থ। আবার কেউ কেউ যাচ্ছেন মামলার হাজিরা দিতে বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে। এমন কয়েকজনকে দেখা গেছে সকালে স্পিডবোট নিয়ে নদী পার হতে।

সকাল পৌনে ৯টায় হঠাৎ শোনা গেল একটি ফেরি ছাড়বে। বরিশাল এক্সপ্রেসের ড্রাইভারকে বলা হলো এক নম্বর ঘাটের দিকে যেতে। তিনি দ্রুত ওই ঘাটের দিকে যেতে পাশ দিয়ে অবৈধভাবে কয়েকটি প্রাইভেট কার যাত্রীবাহী বাসটিকে ওভারটেক করে ফেরিতে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু বাসের কিছু লোক গিয়ে ওই প্রাইভেট কারগুলোকে থামালে সেগুলো আর আগে ফেরিতে উঠতে পারেনি।
ফেরি চলতে শুরু করল কাঁঠালবাড়ি ঘাটের দিকে। যেতে যেতে দেখা গেল চ্যানেলের ভেতরে অন্তত পাঁচটি ড্রেজারে পলি কাটা হচ্ছে। রাতদিন নাকি এভাবে নদীর তলদেশের মাটি কাটা হয়। এই মাটি কাটা নিয়েও রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। দেখা গেল, এক দিকে নদীর তলদেশ দিয়ে পলি কাটা হচ্ছে; আর পাশেই তা ফেলা হচ্ছে। ফলে এক দিক দিয়ে কাটা হচ্ছে; আর অপর দিক দিয়ে আবারো নদীতে নামছে বালু। এম এ সোবহান হাওলাদার নামে এক শ্রমিক নেতা বললেন, এভাবে ২৪ ঘণ্টা পলি সরানোর চেষ্টা চললেও সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।
তবে রাতে ফেরি না চালানোর বিষয়ে পাওয়া গেছে ভিন্ন তথ্য। স্থানীয় কয়েকজন বললেন, সম্প্রতি শ্রমিকেরা ফেরি চালাতে তালবাহানা করলে যাত্রীরা একটি ফেরির কর্মচারীদের মারধর করে। যে কারণে তারা রাতে ফেরি চালাচ্ছে না। এক মন্ত্রীরও নাকি এতে আস্কারা রয়েছে। ওই মন্ত্রীরও ড্রেজার রয়েছে চ্যানেলের পলি কাটার জন্য।

ওই রাতের যাত্রীরা প্রায় ১৪ ঘণ্টা পরে ফেরি পার হতে সক্ষম হন। জানা গেছে এখন প্রায়ই এই ঘটনা ঘটছে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ঘাটে। মাঝে বেশ কিছুদিন সরাসরি কোনো গাড়ি চলেনি ওই রুটে। যাত্রীরা লঞ্চে পারাপার হয়েছেন। এই একই ভোগান্তি চলছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটেও। সম্প্রতি এক মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি ওঠায় তিনি নাকি ক্ষেপেছেন। তাই অনেকটা ইচ্ছে করেই যাত্রীদের এ ভোগান্তিতে রাখা হয়েছে ফেরিঘাটগুলোতে।

http://www.dailynayadiganta.com/last-page/353161