৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ৯:৫০

ভ্রমণের নামে চিকিৎসার জন্য লাখ লাখ মানুষ যাচ্ছে ভারতে

ভ্রমণের নামে চিকিৎসার জন্য দলে দলে লোক যাচ্ছেন বিদেশে। বিশেষ করে একটু জটিল রোগ হলেই দেশের চিকিৎসকদের প্রতি আস্থা রাখছেন না রোগী কিংবা রোগীর স্বজনরা। এমনকি গ্রাম পর্যায়ের রোগীদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছে। বিশেষ করে যাদের আর্থিক অবস্থা একটু স্বচ্ছল তারা দেশে চিকৎসা নিতে মোটেও রাজি না। তার চিকিৎসার জন্য ভারতে ছুটছেন। আর টাকা পয়সা উপার্জন আরেকটু বেশি হলে চলে যাচ্ছে থাইল্যা- সিঙ্গাপুর এবং যুক্তরাষ্ট্রে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগী ও তাদের স্বজনরা দেশের প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসার নামে বাণিজ্য, সঠিক রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থতা, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, অযথা রোগ নির্ণয় পরীক্ষার পরামর্শ ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষার উচ্চমূল্যের কারণেই দেশে চিকিৎসা নেন না অনেক রোগী। এ জন্য দিন দিন সীমান্তের ইমিগ্রেশনগুলোতে রোগীদের লাইন বেড়েই চলছে। জটিল কোনো রোগ হলেই চিকিৎসার জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ছুটছেন আর্থিকভাবে একটু সচ্ছল মানুষগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদেশগামী রোগীদের ৮০ শতাংশই যান ভারতে। অন্যরা যান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে। তাদের মধ্যে অনেকেই ভ্রমণ ভিসা নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। তথ্য মতে, ২০১৭ সালে মোট দুই লাখ ২১ হাজার ৭৫১ জন বাংলাদেশী চিকিৎসার জন্য মেডিকেল ভিসা নিয়ে ভারত গেছেন। বাস্তবে এর সংখ্যা আরও বেশি। কারণ যারা ভ্রমণ ভিসা নিচ্ছেন তাদের ৩০ ভাগ ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক তথ্য মতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে বাংলাদেশী পর্যটকের সংখ্যা ৯ লাখ। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। ইমিগ্রেশন পুলিশের মতে, শুধু বেনাপোল সীমান্ত দিয়েই প্রতিদিন যত মানুষ চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে তার পরিমাণ বছর শেষে দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া দেশের জন্য তাদের জন্য গৌরবের বিষয় নয়। কিন্তু জীবন বাঁচাতে হবে তাই তারা যাচ্ছেন। আমাদের দেশে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায়ই অনিয়ম ও ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর খবর আসে পত্র-পত্রিকায়।

ইমিগ্রেশনগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যের পরিসংখ্যান বলছে বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার মানুষ ভারত যাচ্ছে মেডিকেল ভিসা এবং ভ্রমণ ভিসা নিয়ে। কিন্তু এর মধ্যে গড়ে এক হাজারের উপরে যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য। ২০ শতাংশ মানুষ মেডিকেল ভিসা নিয়ে গেলেও বেশির ভাগই ভ্রমণ ভিসায় গিয়েও চিকিৎসা করাচ্ছেন। যাচ্ছে অন্য স্থল বন্দর দিয়েও। সিলেটের তামাবিল ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, মেঘালয়ে ভালো কোনো হাসপাতাল না থাকায় এই সীমান্ত দিয়ে সবচেয়ে কম রোগী ভারত যায়। তবে অন্যান্য সীমান্ত দিয়ে বেশি যাচ্ছে। তারপরও এ সীমান্ত দিয়ে গড়ে ১০ থেকে ১৫ জন যাচ্ছে।

বিএসএমএমইউ’র মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ মনে করেন, দেশে অনেক রোগী। কোনও হাসপাতালের বেড খালি নেই। যেকোনও মেডিক্যাল কলেজে রোগীকে পর্যাপ্ত বেড দিতে পারছে না। যাদের অর্থ বেশি তারা সুযোগের জন্য বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। যাদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো তারা পাশের দেশে যান, আর যাদের পয়সা কড়ি বেশি তারা সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ডে যাচ্ছেন। এর মানে এই নয় যে, এখানে ফাঁকা করে সব রোগী চলে যাচ্ছেন। তা তো নয়, রোগীই বেশি।
তিনি বলেন, কিছুটা আস্থার সংকট তো আছেই। চিকিৎসকদের ওপর অবিশ্বাস, কিছু ভুল রিপোর্ট আসে, এগুলোও কারণ। যখন আস্থার অভাব হয়, তখন আমাকে দিয়ে তো চিকিৎসা করাবে না। মানুষের প্রাচুর্য বাড়ছে, সামর্থ্য বাড়ছে। সামর্থ্য যখন বেশি থাকে, তখন তো সে ভালো জিনিসটাই খুঁজবে। হার্ট, কিডনি, ফুসফুস এসব জটিল অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে মানুষ তো ভালো সুযোগটাই গ্রহণ করবে। সামর্থ্য না থাকলে তো মানুষ যেতো না।

চিকিৎসক নেতা ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে আমরা ভারত থেকে এগিয়ে আছি। উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে আমাদের চিকিৎসা সেবা ভারত থেকে অনেক ভালো। তবে উচ্চ পর্যায়ে ভারত এগিয়ে। তাদের প্রচুর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে অনেক ভালো যন্ত্রপাতি আছে। ভারতে রোগীদের লাইন দীর্ঘ হবার ব্যাপারে তিনি তিনটি কারণ উল্লেখ করে বলেন, আমাদের দেশের মানুষের আয় বেড়েছে। তাই সামান্য কিছু হলেই ভারত যেতে চায়; আমাদের দেশের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বিপরীতে রোগী থাকে একশ জন। যার কারণে তারা রোগীদের সময় দিতে পারে না। কিন্তু ভারতে বিশেষজ্ঞ প্রচুর থাকায় রোগীকে প্রচুর সময় দেয়; হার্ট বা ক্যান্সারের রোগী হলে পরিবারের সবাই অস্থির হয়ে যায় কোন ডাক্তার রেখে কোন ডাক্তার দেখাবে। তাই তারা কয়দিন দেশীয় ডাক্তার দেখানোর পরেই ভারত যাচ্ছে নিজেদের অস্থিরতা থেকে। তিনি আরও জানান, হার্টের চিকিৎসায় বাংলাদেশ অনেক ভালো করছে।

http://www.dailysangram.com/post/347405