ড. মাহবুব উল্লাহ। ফাইল ছবি
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮, রবিবার, ৯:৪৮

পুনর্জন্ম থাকলে সরকারি কর্মচারী হতাম

ড. মাহবুব উল্লাহ্

কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘আবার আসিব ফিরে/ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়/হয়তো শঙ্খচিল শালিকের বেশে।’ কবি জীবনানন্দ দাশ ছিলেন প্রকৃতিপ্রেমী। তার কবিতায় বারবার বাংলার ছবিতুল্য প্রকৃতির কথা এসেছে।

উদ্ধৃত কবিতাংশটিকে কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেন পুনর্জন্মবাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এই ব্যাখ্যা কতটা সঠিক কিংবা বেঠিক সেই বিতর্কে যেতে চাই না। কবি স্পষ্ট করে মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেননি। তাই এই কবিতাংশ পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাসের প্রশ্নে স্পষ্ট সাক্ষ্য দেয় না।
আমরা জানি, হিন্দু ধর্মমতে পুনর্জন্ম বলে একটা বিশ্বাস আছে। আবার বৌদ্ধধর্মে আছে নির্বাণের বিষয়। এই বিশ্বাস মতে আত্মা নানা আকারে, নানা কায়ার মধ্য দিয়ে বারবার জন্মগ্রহণের পর শেষ পর্যন্ত আত্মা কায়ার বন্ধন থেকে মুক্তি লাভ করে। একেই বলে নির্বাণ। গৌতম বুদ্ধের আরেক নাম ছিল জাতিস্মর।
জাতকের গল্পের মধ্য দিয়ে গৌতম বুদ্ধ তার অতীত জীবনের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। আমরা যারা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, তারা পুনর্জন্মবাদে বিশ্বাস করি না। তারপরও ইসলাম ধর্মে ইহকাল ও পরকাল বলে একটি বিশ্বাস আছে।

কোন ধর্মাবলম্বীরা জীবন ও আত্মার রূপান্তর সম্পর্কে কোন ধরনের বিশ্বাসে বিশ্বাসী তার যৌক্তিকতা প্রমাণ করা এই আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। তবে সরকার সাম্প্রতিককালে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাণ্ডার উজাড় করে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা দেখে মনে হয়েছে পুনর্জন্মের যদি কোনো সুযোগ থাকে তাহলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়েই পুনর্জন্ম লাভের আশা করতাম। নিছক রূপক অর্থে এই কথাটি বলা। কোনো ধর্মীয় বিশ্বাসকে সঠিক বা বেঠিক বলার জন্য নয়। কারও বিশ্বাসকে খাটো করার জন্যও নয়।

সরকারি-কর্মচারীদের ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ি তৈরি বা ফ্ল্যাট কেনার ঋণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। এই ঋণ দিতে ভোটের আগে তড়িঘড়ি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। চলতি বছরের ১ অক্টোবর থেকেই ঋণের আবেদন করা যাবে। ঋণ গ্রহীতাকে ৫ শতাংশ সুদ পরিশোধ করতে হবে।
বাকি সুদ সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে। বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ধরনের ঋণের বিপরীতে সুদের হার ৯ থেকে ১১ শতাংশ। ২৭ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং বাংলাদেশ হাউসবিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের সঙ্গে আলাদা সমঝোতা স্মারক বা এমওইউ সই করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আবাসন আমাদের নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

খাদ্যে ভালো অবস্থানে আছি আমরা, অর্থাৎ জমি কমলেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া শিক্ষায় অগ্রগতি হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতেও উন্নতি হয়েছে, বিশেষ করে কমিউনিটি হাসপাতালগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু আবাসনে পিছিয়ে আছি। এ কারণেই এ খাতে জোর দেয়া।’ তিনি বলেন, ‘শতভাগ আবাসনের ব্যবস্থা করতে সময় লাগবে। এখন ৫০-৬০ শতাংশের আবাসন ব্যবস্থা আছে। বাকিরা থাকেন ‘ঝুপড়ি-টুপড়িতে’ (সূত্র : প্রথম আলো, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮)।
বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধানের উল্লেখ আছে। প্রশ্ন হল, কী করে রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য এসব মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করবে? সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এগুলো নিশ্চিত হয় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে। সংবিধানে সমাজতন্ত্রের উল্লেখ থাকলেও অনুসৃত হচ্ছে বাজার অর্থনীতি।

বাজার অর্থনীতিতে এসব ক্ষেত্রে উন্নয়ন আসতে অনেক সময় লেগে যায়। কারণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে বিষয়টি জড়িত। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষ যখন সক্ষমতা অর্জন করে তখন তারা এসব চাহিদা পূরণ করতে পারে। তবে গৃহায়নের মতো খাতে এককালীন অনেক অর্থের প্রয়োজন হয় বলে অর্থায়নের জন্য বন্ধকী ব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিকরা ঋণ পাওয়ার সুযোগ পায়। অন্যদিকে ইউরোপের দেশগুলোতে কল্যাণ অর্থনীতি চালু হয়েছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর।
ইংল্যান্ডে বিভারিজ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা হয়। এই দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির একটি সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছানোর পরই কল্যাণ সুবিধা চালু করা সম্ভব হয়। কারণ বিষয়টির সঙ্গে রাষ্ট্রের সক্ষমতার প্রশ্নটি জড়িত। তবে অনেকেই মনে করেন, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্যই কল্যাণ অর্থনীতি চালু করা হয়েছে। তবে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে একটি ব্যাপারে একমত হওয়া যায় যে, সবার জন্য গৃহায়ন সুবিধা দেয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভর্তুকি সুদে আবাসন ঋণ প্রদান করা হলে জনগণের কত অংশ এই ঋণ সুবিধা পাবে? সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বাজেট থেকে ভর্তুকি দিয়ে আবাসন ঋণ দেয়া হলে সেই ভর্তুকির অর্থ পূরণ করতে হবে জনগণের প্রদত্ত করের অর্থ থেকে। তাহলে সরকারি চাকুরেদের বাইরে অন্যরা কি বৈষম্যের শিকার হবে না?
জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ এই সুবিধা পাবে, অথচ বিশাল অংশ এর বোঝা বহন করবে। এটা কি যৌক্তিক? এটা কি ন্যায়সঙ্গত? আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা ছিল ‘সাম্য’। মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনার সঙ্গে সরকারের সাম্প্রতিকতম এই উদ্যোগ কি আদৌ ন্যায়সঙ্গত? দুষ্ট লোকেরা বলছেন অন্য কথা।

বলা হচ্ছে অত্যাসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের এই উদ্যোগ কার্যত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আনুগত্য ও সহায়তা ক্রয় করার স্বার্থেই। এর ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন কতটা সম্ভব হবে সেই প্রশ্নও থেকে যাচ্ছে। ফলে গণতন্ত্রের অতি প্রাথমিক শর্ত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারটি কি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে না? গণতন্ত্রও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এরকম উদ্যোগের ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবতার নিরিখে ব্যত্যয়ের মুখে পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেছেন, সব সরকারি কর্মচারীর জন্য সরকার যেহেতু আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারছে না, সেই বিবেচনায় ভর্তুকি দিয়ে হলেও ঋণের ব্যবস্থাটা এক ধরনের ভালোই হয়েছে। আর যেহেতু এটি নির্বাচনের বছর, স্বাভাবিক কারণে সরকার চাইবে কর্মচারীরা খুশি থাকুক। খালেদ সাহেবের শেষ কথাটি সত্যেরই বহিঃপ্রকাশ। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের একটি দাবি আছে।

সরকারি কর্মচারীদের জন্য এমন সুবিধা প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র সরকার কিংবা সরকারি দলেরই আছে। অন্যান্য দলের নেই। অত্যাসন্ন নির্বাচনের মুখে সরকার যখন এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নেয়, তার ফলে প্রকারান্তরে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ব্যাহত হবে। গৃহ ঋণের আগে উপসচিব থেকে শুরু করে উচ্চপদের সরকারি কর্মচারীদের গাড়ি কেনার জন্য সরকার গত বছরের জুন-অক্টোবরে ৪টি প্রজ্ঞাপন জারি করে। অক্টোবরের পর থেকে ১ বছর ধরে এককালীন ৩০ লাখ টাকা করে ঋণ পেয়ে আসছেন তারা।
‘বিশেষ অগ্রিম’ নামের এই ঋণের বিপরীতে তাদের কোনো সুদ দিতে হচ্ছে না। এমনকি সেই টাকা দিয়ে কেনা গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, তেল খরচ ও চালকের বেতন বাবদ সরকার তাদের আরও দিচ্ছে মাসে ৫০ হাজার টাকা করে। শুধু তাই নয়, ঋণ পরিশোধের আগে সরকারের অনুমতি নিয়ে তা বিক্রিও করা যাবে।
২১ মে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিবদের মুঠোফোন কেনার জন্য ৭৫ হাজার টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। এজন্য আগে তারা ১৫ হাজার টাকা করে পেতেন। এছাড়া যুগ্ম সচিবসহ যারা মুঠোফোন পান না, তাদের মুঠোফোনের ভাতা বাড়িয়ে মাসে দেড় হাজার টাকা করা হয়। এর আগে তারা ৬০০ টাকা করে পেতেন (সূত্র : প্রথম আলো, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮)।
বর্তমান সরকার তার অর্থনৈতিক সাফল্যের পক্ষে প্রচার চালাতে গিয়ে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর বক্তব্য ব্যবহার করেছে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ ও একটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিক বসু অর্থনীতির বিচিত্র বিষয় নিয়ে বাংলায় একটি চটি অথচ অত্যন্ত মূল্যবান বই লিখেছেন।

কৌশিক বসুর বইটির নাম ‘অর্থনীতির যুক্তিতর্ক ও গল্প’। এটি কলকাতার আনন্দ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সেই পুস্তকে কৌশিক বসু সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধার বাইরে অন্য কোনো ধরনের বস্তুগত সুবিধা প্রদানের বিরুদ্ধে জোরালো মত প্রকাশ করেছেন।
অর্থনীতি শাস্ত্রে বলা হয়, যে কোনো ভোক্তা তার Utility Maximize করতে চায়, তাই তার সীমিত আয়ের মধ্যে পছন্দক্রম অনুসারে সে জিনিসপত্র কেনে। কিন্তু বাড়ির সুবিধা, গাড়ির সুবিধা ও মুঠোফোনের সুবিধা দেয়া হলে সেটা তার ভোগের স্বাধীনতাকে ব্যাহত করে।
তাই কৌশিক বসু মনে করেন, বেতনের পুরোটাই হওয়া উচিত নগদ অর্থে। যেমন, কোনো কর্মকর্তা সরকারি বাংলোতে থাকলেন, অথচ তার প্রয়োজন ও পছন্দের অগ্রাধিকারে এটি নেই। সে হয়তো এই বাংলো সুবিধার পরিবর্তে নগদ টাকা পেলে কয়েক বছর পরপর সপরিবারে পর্যটন বা ভ্রমণ করে বিনোদন ভোগ করতে পারেন। এটাই হল যুক্তিসঙ্গত ব্যবস্থা।
অন্যদিকে সরকারের সামর্থ্য, ন্যায়বিচার ও সাম্য নীতির মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু করা হলে একসময় এটা সরকারের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং অর্থনীতির র্যা শনালিটি মেনেই নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। কাউকে বেশি খুশি আবার কাউকে অখুশি করে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ মোটেও কাম্য হতে পারে না। দেশের জনগণকে দেশের মালিক বিবেচনা করেই নীতি সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/95580