২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শনিবার, ৯:৪০

অব্যাহতভাবে ব্যয় বাড়ছে

চার লেন মহাসড়ক বাস্তবায়নে ধীরগতি

উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলে ঢিমেতালে, কিন্তু ব্যয় ও সময় বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। আর দুর্বল তদারকির কারণে নির্ধারিত মেয়াদে শেষ হয় না জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো। ঠিক একই চিত্র জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল টু এলেঙ্গা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের। নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পের কাজ হয়েছে মাত্র ৫৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি হলো ৬২ দশমিক ১৩ শতাংশ। মে ’১৮ পর্যন্ত অগ্রগতি ৬০ শতাংশ। প্রকল্পের মেয়াদ মার্চ ’১৮ শেষ হলেও ভূমি অধিগ্রহণ গত মে ’১৮ পর্যন্ত শেষ হয়নি। অন্য দিকে, ব্যয় ২ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে এখন ৫ হাজার ৫৯৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা হয়েছে। শুরু থেকে কোনো বিদেশী ঠিকাদার বা শ্রমিক এই কাজে অংশ নেয়নি। বিদেশী ঠিকাদার অংশ নিলে কাজের গতি ও গুণগতমান আরো ভালো হতো বলে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, জয়দেপুর-চন্দ্রা হয়ে টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পটিও ২ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেয়া হয় ২০১৩ সালের এপ্রিলে। সাসেক রোড কানেকটিভিটি প্রজেক্ট ইমপ্রুভমেন্ট জয়দেবপুর, চন্দ্রা-টাঙ্গাইল এলেঙ্গা রোড টু-এ-লেন হাইওয়ে প্রজেক্ট নামে এই প্রকল্পটিও থমকে থাকে। নকশা ত্রুটি সংশোধনের নামে কাজ শুরুর আগেই ২৭৮ কোটি টাকা শেষ হয়ে যায়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আবুধাবি ফান্ড ও ওপেক ফান্ড এই তিনটি দাতাসংস্থা এতে মোট ১ হাজার ৮৪৩ কোটি ৬৮ লাখ ২১ হাজার টাকার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। এ পর্যন্ত এই প্রকল্পের ব্যয় তিন দফায় বাড়ানো হয়েছে। প্রথম দফায় সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ৩ হাজার ৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা করা হয়। এরপর এই ব্যয় আবারো বাড়িয়ে ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা করা হয়। ২০১৮ সালের মার্চের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। শেষবার ব্যয় বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫ হাজার ৫৯৬ কোটি ১৫ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। আর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।

সরেজমিন প্রতিবেদনে আইএমইডি বলছে, বিদেশী ঠিকাদার চুক্তি অনুযায়ী অংশ নিলে দেশীয় ঠিকাদারের প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা আন্তর্জাতিক মানের কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারত। প্রকল্পের শুরুতেই যথাযথ পরিকল্পনার অভাবই মূল সমস্যা। প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইকালীন কোনো ধরনের তদারকি হয়নি। স্টাডি প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা ছাড়াই গ্রহণ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে অ্যালাইনমেন্টে বাঁক সরলীকরণ বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি। ভূমি অধিগ্রহণেই রয়েছে অনেক ভুলত্রুটি। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম জমি নির্ধারণ করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঠিকাদার এখনো ভূমি বুঝে পায়নি বলে জুন পর্যন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন। ফলে ওইসব স্থানে কাজ শুরু করতে পারেনি তারা।
সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভূমি অধিগ্রহণ করতে না পারার কারণে মেয়াদ বাড়ানো হয়। আগামী ২০২০ সালের জুনে বর্ধিত সময়েও এই প্রকল্প সমাপ্ত হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় রয়েছে। কারণ যেখানে মে ’১৮ পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৬০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদারের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, প্রয়োজনীয় মালামাল দ্রুত সংগ্রহ, দ্রুত ভূমি অধিগ্রহণ, তদারকিতে আরো মনোযোগী হওয়া দরকার।

মূল প্রকল্পটিতে কোনাবাড়ী ফাইওভার, চন্দ্রা ফাইওভার, লতিফপুর রেলওয়ে ওভারপাস, সোহাগপুর (ধেরুয়া) রেলওয়ে ওভারপাস ও রাবনা ফাইওভার ছিল। দ্বিতীয় সংশোধনীতে নাওজোর ফাইওভার, শফিপুর ফাইওভার, চন্দ্রা লুপ, কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক ফাইওভার, লতিফপুর রেলওয়ে ওভারপাস, গোড়াই ফাইওভারসহ মোট ছয়টি ফাইওভার ও ১৩টি আন্ডারপাস এবং ডান পাশের ৫১ কিলোমিটার এসএমভিটি লেন অর্থাৎ ধীর গতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, এই প্রকল্পের চারটি প্যাকেজে চারটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঠিকাদার একই কাগজপত্র সব জায়গাতে দাখিল করেন। অনেক জায়গাতে কাজ পেয়ে সব কাজে প্রয়োজনীয় মালামাল, উপযুক্ত লোকবল, যন্ত্রপাতি যেমন দিতে পারে না, তেমনিভাবে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায়ও অভাব থেকে যায়। এতে কাজের গুণগতমান যেমন ক্ষুণœ হয়, আবার সঠিক সময়ে কাজ শেষ করাও সম্ভব হয় না। জানা মতে, এই প্রকল্পের ঠিকাদাররাও বিভিন্ন সংস্থায় একাধিক কাজে নিয়োজিত আছেন বলে আইএমইডির অভিমত। পাশাপাশি দেশীয় পরামর্শক সংস্থাগুলো একাধিক কাজ নিয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রকৌশলী সব জায়গায় নিয়োগ দিতে পারে না। এতে কাজে যেমন ব্যাঘাত ঘটে, তেমনি কাজের গুণগত মান যাচাই করা সম্ভব হয় না।

বলা হয়েছে, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এডিবি রিভিউ প্যানেলের রায়ের সাথে একমত না হয়ে দরপত্রে প্রদত্ত শর্তানুযায়ী সড়কের কাজে যোগ্যতাসম্পন্ন ঠিকাদারদের দরপত্র মূল্যায়নের জন্য মত প্রদান করে। সে অনুযায়ী দরপত্র মূল্যালন করা হয়। আর এ কারণেই দরপত্র মূল্যায়নে চার মাস সময় অতিরিক্ত ব্যয় হয়।

পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বলছে, এই প্রকল্পের আওতায় জয়দেবপুর-চন্দ্রা-টাঙ্গাইল-এলেঙ্গা ৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কটি উভয় পাশে এসএমভিটি লেনসহ ছয় লেনে উন্নীতকরণ হলে দেশের উত্তরাঞ্চলের সাথে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ এই মহাসড়কাংশ ব্যবহার করে ভবিষ্যতে বাংলাবান্ধা দিয়ে ভারত ও নেপাল এবং বুড়িমারী দিয়ে ভারত ও ভুটানের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক সড়ক সংযোগ সহজতর হবে। একই সঙ্গে জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে।

আইএমইডির পরিদর্শক কর্মকর্তাদের অভিমত, সঠিক সময়ে প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার পরও তা সময় মতো দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে কাজ শুরু না করার কারণে প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে যায়। ফলে ব্যয় বাড়ছে। আর প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর এডিপিতে টানতে হচ্ছে। সড়ক খাতের প্রকল্প এমনও রয়েছে তা ১০-১২ বছর ধরে চলছেই। কোনোভাবেই এর সমাপ্তি হচ্ছে না। চার ও আট লেনের প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠছে।
প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্টরা জানান, রাস্তার এক পাশে এসএমভিটি লেন, অতিরিক্ত ফাইওভার, ১৩টি আন্ডারপাস ও যাত্রী শেড নির্মাণ এবং রাজস্ব খাতে যানবাহন রেজিস্ট্রেশন ফি, বিদ্যুৎ বিল, এনভায়রনমেন্ট কিয়ারেন্স ফি-সহ বিভিন্ন ফি বৃদ্ধির কারণে ব্যয় বাড়াতে হয়েছে। নতুন করে কিছু কিছু অঙ্গ যুক্ত করা হয়েছে প্রকল্পে।


http://www.dailynayadiganta.com/last-page/352888