২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শনিবার, ৯:৩৬

বয়স সবাইকে থামতে বলে

আগে আমি ছিলাম ‘ভাই’, তারপর হয়েছি ‘আঙ্কেল’, এখন ‘মুরুব্বি’। সেদিন জুমার নামাজ পড়ে মসজিদের দোতলা থেকে নামতে গিয়ে সিঁড়ির রেলিং ধরতে চাইলাম। বৃষ্টির কারণে কয়েকটি ছেলে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমার রেলিং ধরা দেখে এক ছেলে অন্য ছেলেকে বলল, এই মুরুব্বিকে নামতে দে। তারা সরে গেলে আমি রেলিং ধরে নিচে নেমে ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। আগে মধ্যম বয়সের লোকেরা আমাকে আঙ্কেল ডাকলে মনে মনে ভাবতাম, এই লোকগুলো আমাকে আঙ্কেল ডাকছে কেন, আমি কি তবে বুড়ো হয়ে গেছি! মানুষের এসব সম্বোধন মানিয়ে নিয়েছি। এখন আর কিছুই মনে হয় না। যেভাবে ডাকে ডাকুক। বয়সের কাছে হার মানতে শুরু করেছি। কোনো লোকের মৃত্যু সংবাদ সংবাদমাধ্যমে দেখলে আগে পড়ার চেষ্টা করি তার বয়স কত। আমার চেয়ে কম বয়সের কেউ মারা গেলে ভাবি- লোকটা মরল কেন, আর কী অসুখ হয়েছিল, তিনি কি অসুখের সঠিক চিকিৎসা করেছিলেন। আর আমার থেকে বেশি বয়সের লোক মারা গেলে ভাবি- লোকটা ভাগ্যবান, অনেকদিন বেঁচে ছিল। আর আশি-নব্বই পার হয়ে কেউ মারা গেলে ভাবি- বংশানুক্রমে ওরা বেশি বয়সে মারা গেছেন। ওদের শরীরের গঠনই ছিল বেশি বয়সে মরার জন্য উপযুক্ত, আর তাদের নিয়ে এমনও ভাবি- তারা হয়তো শরীরের বেশি যত্ন নিয়েছেন। সে জন্যই বেশিদিন বেঁচে ছিলেন।

শরীরের যত্ন বলতে কী বোঝায়? সেটাও একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। সবার শরীরের জন্য একইরকম যত্নের দরকার হয় না। শরীর বুঝে যত্নের প্রয়োজন হয়। তবে যারা অপেক্ষাকৃত কম বয়সে মারা যান, তারাও যে শরীরের যত্ন নেননি এমন নয়। যত্ন তাদের বাঁচাতে পারেনি। দুরারোগ্য রোগ কখন কাকে আক্রমণ করে ঠিক নেই। আগে মনে করতাম মারাত্মক রোগগুলো শুধু ‘গুনাহগারদের’ হয়। এখন দেখি, ‘গুনাহগার’ না হলেও অনেকে ওইসব রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে রোগব্যাধি বেশিই। এত ওষুধ অন্য দেশের লোকেরা সেবন করে না। আমাদের শহরগুলোর অলিতে-গলিতে ওষুধের দোকান। অন্য কোনো দেশে কি এত ওষুধের দোকান চোখে পড়ে? আমাদের ডাক্তার সাহেবরাও রোগীর জন্য বেশি ওষুধ লেখেন। এটা তারা করেন নিজেদের স্বার্থে, নতুবা অজ্ঞানতা থেকে। বেশি ওষুধ খেলে বেশি ভালো থাকা যায় এ ধারণা ভুল। বরং সত্য হল, যারা বেশি ওষুধ সেবন করেছে তারাই চিরস্থায়ী রোগী হয়েছে। ওষুধ শুধু রোগ সারায় না, রোগও সৃষ্টি করে।

আমাদের চারদিকের পরিবেশ বিষাক্ত। পরিবেশ ঠিক না করতে পারলে বাংলাদেশ যদি পুরোটা হাসপাতালও হয়ে যায়, তাহলেও এ দেশের লোকদের চিকিৎসা হবে না। আমরা যা খাচ্ছি তার সবই কি খাওয়ার উপযুক্ত? মাটি আমাদের বিশুদ্ধ খাদ্য দিতে তৈরি। আমরাই খাদ্যের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে পরে সে খাদ্য গ্রহণ করছি। এতে আমাদের শরীরের যে ক্ষতি হচ্ছে তা বিশ্বের কোনো ডাক্তার বা ওষুধ কি সারাতে পারবে? হাসপাতালগুলোতে যাই কখনও নিজের পরিবারের কাউকে নিয়ে, কখনও অন্য জানাশোনা রোগী দেখতে। আহা! সে কী দৃশ্য! যার কোনো অসুখ হওয়ার কথা নয় সেও অসুখে আক্রান্ত। জিজ্ঞেস করলে বলে তার এই হয়েছে, ওই হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও অসুখগুলো যেন বয়স মানে না। কোনো ছেলের বা মেয়ের বড় কোনো অসুখ দেখলে নিজের অজান্তে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে পড়ে। যে বয়সে জীবনকে উপভোগ করার কথা সে বয়সে তারা আজ হাসপাতালের বেডে।

আমার কাছে একটা বিরক্তিকর সময় হল ডাক্তারের কাছে গিয়ে ক্রম নম্বর আসার জন্য বসে থাকা। মাঝে মধ্যে মনে হয় এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা না করে চলে আসাই ভালো। কিন্তু অন্যরা যেমন বসে আছে, আমাকেও তেমনি বসে থাকার ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। আমি ভাবি- যারা বসে আছেন তারা কি সবাই রোগী? এরা কি সদ্য রোগী হয়েছেন, না অনেকদিন থেকেই রোগী হয়ে বসে আছেন? আবার এও ভাবি- এরা কি সবাই প্রকৃত অর্থে রোগী, নাকি না বুঝে নিজেদের রোগী ভেবে ডাক্তারের কাছে এসেছেন? অনেকে হয়তো বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, তবে বাংলাদেশের মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য হল, এদের মধ্যে অনেকে প্রকৃত অর্থে কোনো রোগী নন, কিন্তু নিজেদের রোগী ভেবে বসে আছেন। এটা হল আরেক বড় ব্যাধি। যারা রোগাক্রান্ত না হলেও নিজেদের রোগী ভেবে বসে আছেন, তারা একদিন প্রকৃত অর্থেই রোগী হতে বাধ্য! এবং এরা রোগী হলে এদের রোগ সারানো কঠিন হয়। কারণ, এরা যতই সুস্থ থাকুন না কেন সুস্থতা নিয়ে ভাবেন না, এরা সব সময় রোগকে নিয়েই ভাবেন। যে ব্যক্তি সারাক্ষণ রোগ গিয়ে ভাবেন তার চিকিৎসা করা কঠিন, অন্তত ট্যাবলেট-ক্যাপসুল তার জন্য কোনো কাজে আসবে না।

এ ধরনের ক্ষেত্রে অনেকে মনোরোগের কথা বলেন। পুরনো দিনে এই রোগটা অনেক কম ছিল। এখন মনোরোগই হল অনেক পরিবারের আসল রোগ। এ রোগেরও কি চিকিৎসা আছে? মানুষ তো বলে, আছে। তবে মনোরোগের চিকিৎসার ধরন আর পথ ভিন্ন। একবার আমারও মনোরোগ হয়েছিল। নিউমার্কেটে আমাকে দেখে এক লোক বলল, এই রোগের কোনো ওষুধ নেই, বেশি করে আল্লাহর মেহেরবানি স্মরণ করুন। পরে লোকটাকে আর পেলাম না। লোকটা বলেছিল, সে নিজেও একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। পরে আমারও মনে হল তার কথাই ঠিক। ডাক্তারদের দেয়া ঘুমের ওষুধ, বিষাদ অবসানের ওষুধ- এসব সেবন করে কেউ মনোরোগ তাড়াতে পারেনি। আলহামদুলিল্লাহ, আমার মনোরোগটা ছিল ক্ষণস্থায়ী। পরে আস্তে আস্তে চলে গেছে। কিছু মূল্যবান ভাবনার মধ্যে একটা হল নিজেকে ভালো আছি মনে করা। এটা ভাবতে না জানলে সে কোথাও সুখ খুঁজে পাবে না। জীবন হবে তার জন্য বোঝা।

যাক, বয়স নিয়ে কথা বলছিলাম। বয়সেরও একটা ভার আছে। আর সেই ভার বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। একদিন ভারটা এত ভারী হয় যে তা জীবনকেই থামিয়ে দেয়। আমি যখন ষাট বছর পেরোচ্ছিলাম তখন মনে হতো সবেমাত্র বয়স বাড়া শুরু হয়েছে। এর আগে বয়স বাড়ছে না কমছে তা নিয়ে ভাবার সময়ই পাইনি। কখন যে সেই আমি- তরুণ লোকটি- বৃদ্ধ হয়ে গেছি টেরই পাইনি। এখন টের পাচ্ছি আমার বয়স বেড়ে গেছে। সবকিছু ঠিকমতো যাবে এটা আশা করা ঠিক নয়। শরীর যখন কাজ করতে চায় না তখন অলক্ষ্যে নিজকে সান্ত্বনা দিই- আমার বয়স হয়ে গেছে। এখন আর আগের মতো সময় দেয়া সম্ভব নয়।

সুস্থতা হল সৃষ্টিকর্তার বড় নেয়ামত। যারা বেশি বয়সেও সুস্থ আছেন, তাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে সদা কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। চলনে-বলনে মহান সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করা উচিত, যিনি দয়া করে তাদের সুস্থ রেখেছেন। বয়স সবাইকে থামতে বলে, অনেক ইশারা-ইঙ্গিত দেয়। কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না। তবে না বুঝলেও একদিন বয়স সবাইকে থামিয়ে দেবেই।
আবু আহমেদ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

 

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/95251