২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শনিবার, ৯:০৩

নদী ও নদীরে তোমার কেন এমন দশা?

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : ফারাক্কার উজানে গঙ্গার জল উথালপাতাল করলেও ভাটিতে এর অন্যনাম পদ্মার মরণদশা দেখলে প্রকৃতিপ্রেমিক যেকোনও মানুষের বুক ভেঙে যায়। হৃদয় হাহাকার করে ওঠে।
আমার জন্মভূমি প্রায় হিমালয়ের পাদদেশ ঠাকুরগাঁও হলেও রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের পদ্মার চরাঞ্চলের সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক। তাই কৈশোর ও যৌবনের রঙিন দিনগুলো পদ্মার উন্মত্ততা দেখতে দেখতে কেটেছে বলা যায়। পদ্মাকে যেমন বাঁধভাঙা মাতঙ্গিনীরূপে দেখেছি মানুষের ঘরবাড়ি, জমিজিরাত, হাটবাজার ভেঙে ভাসিয়ে নিতে, ঠিক তেমনই এখন দেখছি এ নদীর বুকে জেগে ওঠা দিগন্তজোড়া ধূধূ বালুকারাজি। ৭০ ও ৮০ এর দশকে শুখা মওসুমে পদ্মার যে টইটুম্বুর রূপ আমি দেখেছি তা এখন আর ভরাবর্ষাতেও চোখে পড়ে না। তবে মাঝেমাঝে এর ভীষণ প্রচণ্ডতা দেখা যায়। এবার যেমন শরিয়তপুরের নড়িয়া ও জাজিরা অঞ্চলে আধমরা পদ্মাকে ক্ষুব্ধ এবং রাগান্বিত দেখা গেল। ভেঙেচূরে ভাসিয়ে নিলো বহু মানুষের ভিটেমাটি আর ফসলের মাঠ।

ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে গঙ্গা বা পদ্মার পানি এক তরফা প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের বিরাট এলাকাজুড়ে মরুপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ঋতুপরিক্রমায়ও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। গরমকালে বাড়ছে গরম। প্রতিবছর বাড়ছে তাপমাত্রা। শীতে বাড়ছে শীত। গতবার উত্তরাঞ্চলে শীতকালে তাপমাত্রা ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। হয় তুষারপাতও। পরিবর্তন ঘটছে কৃষিক্ষেত্রে। বদলে যাচ্ছে মওসুম। ধীরে ধীরে বর্ষাকাল যাচ্ছে হারিয়ে।

শুধু পদ্মাই নয় উত্তরাঞ্চলের সব নদ-নদী এখন মৃতপ্রায়। বর্ষাকালে কিছু পানি বাড়লেও শুখা মওসুমে প্রায় নদীর বুক খালি হয়ে যায়। এলাকার লোকজন দখলে নিয়ে চাষাবাদ শুরু করে। পদ্মার মতো বিশাল নদীর বুক দিয়ে এখন চলে গরুগাড়ি। পদ্মার মরণদশা এখন তিস্তাকেও গ্রাস করছে। উত্তরাঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ নদীকে মরাখাল ব্যতীত কিছু বলবার উপায় নেই।
সাউথ এশিয়ান মনিটর রিপোর্ট করেছে : তিস্তার জল নিয়ে বিরোধ এবার সিকিমে গড়িয়েছে। সাবেক পশ্চিমবঙ্গ বর্তমানে বাংলা সরকার বারবার সিকিমে তিস্তার ওপর গড়ে ওঠা একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে অভিযোগ করেছে। তবে সম্প্রতি রাজ্য সরকার তিস্তার জল নিয়ে একটি রিপোর্ট ভারত সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। এ রিপোর্টে বলা হয়েছে: সিকিমে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তিস্তার ৬০ শতাংশ জল আটকে রাখবার ফলে তিস্তার পানিপ্রবাহ ১০০ কিউসেকে নেমে এসেছে।
তিস্তায় এপ্রিল-মে মাসের শুখা মওসুমে বাংলাদেশ ও বাংলার সেচের জন্য তিস্তায় প্রায় ১৬০০ কিউবেক (কিউবিক মিটার পার সেকেন্ড) জল থাকা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে বর্তমানে জল রয়েছে এর ১৬ শতাংশ কম। আর তাই এ বছর বাংলার সেচ এলাকা কমিয়ে ৫২ হাজার হেক্টরে নামিয়ে এনেছে রাজ্য সরকার।

তিস্তায় শুখা মওসুমে জল কম থাকবার জন্য বিশেষজ্ঞরা সিকিমে তৈরি হওয়া ৮টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকেই দায়ী করেছেন। বাংলা সরকারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রায় ৬০ শতাংশ জল ধরে রাখছে। আসলে জল আটকে রেখে পরে তা নদীতে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা এসব বিদ্যুৎপ্রকল্পে থাকলেও কোন সময় তা ছাড়া হবে তা নিয়ে কোনও সমন্বয় না থাকায় মাঝেমাঝেই তিস্তা জলশূন্য হয়ে পড়ছে।
উল্লেখ্য, তিস্তা সিকিমের প্রায় ২৩ হাজার ১৫৯ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত খানচুং ছো হিমবাহ থেকে উৎপন্ন লেক থেকে বেরিয়ে ১৫১ কিলোমিটার সিকিমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কালিম্পংয়ের রংপোর কাছে বাংলার সমতলে প্রবেশ করেছে। সিকিমে অবশ্য বেশ ক’টি ছোটনদী এসে মিশেছে তিস্তায়। পশ্চিমবঙ্গ তথা বর্তমান বাংলার ১৪২ কিলোমিটার প্রবাহিত হবার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে সেটি ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে।
গত এক দশকে সিকিম ও বাংলায় ছোট-বড় অসংখ্য জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এগুলোর অনেক ক’টিই ইতোমধ্যে চালু হয়ে গিয়েছে। এছাড়া উজানে ক্যানেল কেটে জল সরিয়ে নেয়া হচ্ছে সেচ প্রকল্পের জন্য।

২০১৩ সালে প্রকাশিত এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক রিপোর্টে বলা হয়: ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রায় ৩০টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সিকিমে তৈরি হয়েছে ৮টি এই ধরণের বিদ্যুৎ প্রকল্প। এজন্য তৈরি করা হয়েছে বিশাল বিশাল বাঁধ। এসব বাঁধে জল আটকে ক্যানেলের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। পরে তা আবার নদীতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। বাংলার দার্জিলিংয়েও তৈরি হচ্ছে দুটি বাঁধ। তবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জল ব্যবহারে যে ৫ শতাংশ করে জল নষ্ট হয়ে যায় সে কথা বিশেষজ্ঞরাই জানিয়েছেন। তাছাড়া সাময়িকভাবে হলেও তিস্তার জল আটকে রাখবার ফলে তিস্তার জলে স্বাভাবিকভাবেই টান পড়ছে।

নদী হচ্ছে প্রকৃতির শ্বাসনালি। রক্তনালিও বলা যায়। মানুষ বা প্রাণি যেমন অক্সিজেন এবং রক্ত ছাড়া বাঁচে না; ঠিক তেমনই দেশ বা জনপদও নদী ব্যতীত বাঁচতে পারে না। বাংলাদেশের উজান থেকে নেমে আসা নদীগুলোর পানিপ্রবাহ আটকে দিয়ে প্রতিবেশী দেশটি আমাদের নদীমাতৃক বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করবার অশুভ খেলায় মেতে উঠেছে। দিল্লি বাংলাদেশের শ্বাস ও রক্তনালি বন্ধ করে দিয়ে গলাটিপে মেরে ফেলতে উদ্যোগ নিয়েছে। এটা কোনও বন্ধুদেশের কাজ নয়।
উজানের প্রায় সব নদ-নদীতে ভারত কর্তৃক বাঁধ-গ্রোয়েন নির্মাণ করে এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশে মরুপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পরিবর্তিত হচ্ছে আবহাওয়া। বিশেষত পদ্মা ও তিস্তার সিংহভাগ পানি প্রত্যাহারের ফলে এ দুই নদীই কেবল শুখা মওসুমে প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ে না। অন্য নদীগুলোর অবস্থাও খুব খারাপ। কোনও কোনও নদী ইতোমধ্যে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। বাকি যেক’টি আছে সেক’টিও প্রায় বিলুপ্তির পথে। পদ্মা ও তিস্তার প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাবার ফলে উত্তর জনপদের টাঙ্গন, তিরনাই, তেঁতুলিয়া, সেনুয়া, ধরলা, পুনর্ভবা, মহানন্দা, আত্রাই, নাগর, কাঞ্চন, করতোয়া, ঢেপাসহ ছোট ছোট সব নদ-নদী এখন পানিশূন্য। এগুলোতে মাছ ধরে অনেক মানুষ জীবিকানির্বাহ করতো। তারা সবাই এখন বেকার। এসব নদীতে হাজারো প্রজাতির ছোটবড় দেশি সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেতো। তাও নেই। ফলে পুরো উত্তরাঞ্চলে মাছের তীব্র অভাব। একই কারণে মাটির জলস্তরও প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র প্রকল্পসহ উত্তরাঞ্চলের সেচপ্রকল্পগুলো অকেজো হচ্ছে। গভীর নলকূপগুলো কয়েক বছর পরপর নিচে নামাতে হচ্ছে। হাতে চাপা নলকূপে খাবার পানি পাওয়া মুশকিল হচ্ছে। নদ-নদীর সঙ্গে খাল-বিল, পুকুরগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। এর অশুভ প্রভাব পড়ছে চাষাবাদে।

এক সময় দেখেছি, টাঙ্গন নদীতে দুই পাড়ের লোকজন গোসল করতো। মহিলারা গোসল সেরে কলসি ভরে পানিও নিয়ে যেতো। নদীর পানিতে ধোয়ামোছাসহ রানাবান্না সেরে নিতো। এমনকি নদীর এ পানি মানুষ পানও করতো তখন। পানি ছিল বেশ স্বচ্ছ এবং সুস্বাদু। কিন্তু এখন আর সেদিন নেই। নদীর বদ্ধ পানিতে স্রোত যেমন নেই, তেমনই তা পানোপযোগীও নয়। শুধু টাঙ্গন কেন, পদ্ম, মহানন্দা, তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই নদীর একই দশা হয়েছে। নদী এখন নদী নয়, যেন মরাখাল।
অনেক দেন-দরবার করেও পদ্মার পানিসমস্যার সুরাহা হয়নি। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা পানিসমস্যার বিষয়টি যেন ভুলেই যেতে বসেছেন। বলা চলে তাঁরা এখন ক্ষমতারক্ষা নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলোর পানিসমস্যা দ্রুত নিরসন না হলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি মরুভূমিতে পরিণত হবে। এর আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে দেশময়। আসলে নদী মানে জীবন। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচে। দেশ বাঁচে। নদী মরে গেলে মানুষ বাঁচতে পারে না। দেশ হারিয়ে যায়। বিপন্ন ও বিলীন হয় জনপদের পর জনপদ। দুঃসহ ও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে মানুষের জীবনযাপন। সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে মানুষের জীবিকা। এমনকি তা রুদ্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কাও তীব্রতর হয়ে পড়ে। তাই নদীরক্ষার সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে মানুষকেই।
উত্তর জনপদের কোনও নদীর তীরে দাঁড়িয়েই এখন আর প্রাণ জুড়োয় না। মন ভরে না। নদীর খালি বুক দেখে শিল্পী-কবির ভাবুক মনও হাহাকার করে ওঠে বারবার। বিশাল শূন্যতায় যেন ভরে যায় হৃদয়। প্রশ্ন জাগে, ‘নদী ও নদীরে তোমার কেন এমন দশা?’

http://www.dailysangram.com/post/347274