২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, শুক্রবার, ৮:৩৫

রোহিঙ্গা গণহত্যার প্রমাণ সংগ্রহে নামছে জাতিসংঘ

মিয়ানমারকে রক্ষায় গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও জেনেভায় সরব ছিল চীন। রোহিঙ্গা গণহত্যার তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের প্রস্তাবকে যেখানে ১০০টি দেশ সমর্থন দিয়েছে সেখানে চীন জানাল প্রস্তাবটি নিয়ে মানবাধিকার পরিষদের অধিবেশনে ভোট হতে হবে। কিন্তু ভোটে যে ফল এলো তাতে মিয়ানমারের আর রক্ষা হলো না। মানবাধিকার পরিষদের ৩৫টি সদস্য রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে এবং তিনটি সদস্য বিপক্ষে (চীন, ফিলিপাইন ও বুরুন্ডি) ভোট দিয়েছে। ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে সাতটি সদস্য রাষ্ট্র (জাপান, নেপাল, অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, মঙ্গোলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা)।

গত রাত ৮টায় জেনেভায় ওই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর এবার মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ কাঠামো সৃষ্টির জন্য শুধু সাধারণ পরিষদের আনুষ্ঠানিকতা বাকি। মানবাধিকার পরিষদে গত রাতে গৃহীত প্রস্তাবে ২০১১ সাল থেকে মিয়ানমারে সংঘটিত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অত্যন্ত গুরুতর সব অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ, একীভূত, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য একটি স্বাধীন কাঠামো সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই কাঠামো আগামী দিনে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশীয়, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে দ্রুত ও সুষ্ঠু বিচারের জন্য মামলার নথিপত্র তৈরি করবে। শুধু রোহিঙ্গা মুসলমান নয়, সংখ্যালঘু অন্য নৃগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত গুরুতর অপরাধগুলোর তথ্য-উপাত্তও সংগ্রহ করবে ওই স্বাধীন কাঠামো।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সিরিয়ার আদলে মিয়ানমারে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। মানবাধিকার পরিষদ তার গৃহীত প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকতার জন্য সাধারণ পরিষদে পাঠাবে। সাধারণ পরিষদ তা বাস্তবায়নের জন্য জাতিসংঘ মহাসচিবকে দায়িত্ব দেবে। ওই কাঠামো সৃষ্টির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘের স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী দলের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে।
জানা গেছে, চীন, রাশিয়ার মতো দেশগুলো এ উদ্যোগের সমর্থক না হলেও তাদের আপত্তি টেকেনি। কারণ মানবাধিকার পরিষদ বা সাধারণ পরিষদে কারো ‘ভেটো’ ক্ষমতা নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ওই প্রস্তাব সহজেই গৃহীত হয়েছে। নবগঠিত কাঠামো নির্দিষ্ট সময় পর পর জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ ও সাধারণ পরিষদকে তাদের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতি সব সময় একই রকম থাকবে না। আজ মিয়ানমারের বিচার প্রশ্নে পরাশক্তিগুলো একমত না হলেও ভবিষ্যতে বিচারের সময় যাতে তথ্য-প্রমাণ হারিয়ে না যায় সে জন্যই এই কাঠামো সৃষ্টি করে সেগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। এমনভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হবে যাতে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) চাইলে তা কাজে লাগাতে পারেন। আইসিসির বাইরে কখনো মিয়ানমারের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হলে ওই তদন্ত কাঠামোই জাতিসংঘ নিযুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে তথ্য-প্রমাণ দাখিল করবে।
গত রাতে ভোটের আগে জেনেভায় চীনা রাষ্ট্রদূত ওই প্রস্তাবকে ‘বিতর্কিত’ হিসেবে আখ্যায়িত করে সবাইকে এর বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অন্ধভাবে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়। বরং সবার উচিত ওই দেশটির সঙ্গে গঠনমূলকভাবে সম্পৃক্ত থাকা।
মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত বলেন, বিতর্কিত সত্যানুসন্ধানী দলের একপেশে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রস্তাব আনা হয়েছে। প্রস্তাবটি মিয়ানমারের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত।
পদ সৃষ্টি ও অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা হচ্ছে : জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ে প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সম্ভাব্য পদ ও বাজেট সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন এর পরিকল্পনা ও বাজেট বিভাগের পরিচালক জোহান্স হুইসম্যান। সত্যানুসন্ধানী দলের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জেনেভায় এর দপ্তরসহ অন্যান্য কার্যক্রম বাবদ ২০১৮-১৯ অর্থবছরেই খরচ হবে ২৭ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার, যা ২৩ কোটি ২১ লাখ টাকারও বেশি।

মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্য কাঠামোতে সাতজন কর্মীর সমন্বয়ে একটি নির্বাহী দপ্তর, ৩১ জন কর্মীর সমন্বয়ে সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও বিনিময় বিভাগ, ১২ জন কর্মীর সমন্বয়ে তথ্যব্যবস্থা ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ছয়জন কর্মীর সমন্বয়ে ভাষা সহায়তা সেবা বিভাগ এবং ছয়জন কর্মীর সমন্বয়ে প্রশাসনিক সেবা বিভাগ থাকবে। অর্থাৎ মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের জন্য কাঠামোতে অন্তত ৬২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবেন। ওই কাঠামোর জন্য বছরে প্রায় এক কোটি ৫১ লাখ ৩৩ হাজার ১০০ মার্কিন ডলারের (প্রায় ১২৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকা) বাজেট প্রয়োজন হবে।

এ ছাড়া নতুন কাঠামোর জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে বছরে এক লাখ ৭৯ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার (প্রায় দেড় কোটি টাকা) বাজেট প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ মিয়ানমারের অপরাধের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে আগামী এক বছরেই প্রায় ১৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হবে জাতিসংঘকে। পরবর্তী বছরগুলোতেও এমন বরাদ্দ প্রয়োজন হবে।

প্রস্তাবে আরো যা আছে : ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে অস্ট্রেলিয়া এবং ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে পাকিস্তান জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে যৌথভাবে প্রস্তাবটি এনেছিল। জাতিসংঘের স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে মিয়ানমারে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের মতো গুরুতর অভিযোগ ওঠার বিষয়টি আমলে নিয়ে সার্বিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানানো হয়েছে প্রস্তাবে। এ ছাড়া মিয়ানমারকে মানবাধিকারসহ আন্তর্জাতিক আইনের ভয়াবহ লঙ্ঘন ও নিপীড়নের জবাবদিহি নিশ্চিত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

মানবাধিকার পরিষদ, স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী দল, সংঘাতকালীন যৌন সহিংসতাবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধিসহ অন্যদের প্রতিবেদনে মিয়ানমারে ধারাবাহিক ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের পূর্ণ ও স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে প্রস্তাবে। এ ছাড়া মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের মতো সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর রাষ্ট্রহীনতা দূর করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বিশেষ করে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ও তাদের আশ্রয় দেওয়া স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য তহবিল গড়তেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানানো হয়েছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2018/09/28/685088