২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:১৯

জিডিপিতে পর্যটনের অবদান কমছে

পাহাড়ের দুর্গম এলাকায় এখনো অজানা রয়ে গেছে অনেক পর্যটন স্পট। সম্প্রতি খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় তেজাংমা নামের দৃষ্টিনন্দন এই ঝরনা পর্যটকদের নজর কাড়ছে। ছবি : কালের কণ্ঠ
মালয়েশিয়ার জাতীয় অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প বছরে অবদান রাখছে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলার। ২০১৫ সালে ২৮.৮ মিলিয়ন পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য নেয় থাইল্যান্ড। নেপালেরও জাতীয় আয়ের ৪০ শতাংশের উৎস পর্যটন খাত। এশিয়ার এসব দেশ পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে প্রতিনিয়তই নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলছে। কিন্তু বাংলাদেশের জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) এই খাতের অবদান মাত্র ২.২ শতাংশ। দেশে নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, পুরাকীর্তি অনেক কিছুই আছে। কিন্তু এসব পর্যটনপণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে বাণিজ্যিক সাফল্য নেই।

প্রথমবারের মতো তিন বছরব্যাপী ‘পর্যটন বর্ষ-২০১৬’ ঘোষণার সময় ১০ লাখ পর্যটক আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু বিদেশি পর্যটক বেড়েছে এমন হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান বাড়ছে না।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডাব্লিউটিটিসি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ অর্থবছরে
বাংলাদেশের জাতীয় আয়ে ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২.২ শতাংশ। এর আগে ২০১৫ সালে ছিল জিডিপির ২.৪ শতাংশ। সেই হিসাবে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান কমেছে। ডাব্লিউটিটিসির গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটন খাতে সম্পৃক্ত। ২০২৬ সালে বাংলাদেশে এ খাতে শুধু প্রত্যক্ষভাবেই ১২ লাখ ৫৭ হাজার লোক কাজ করবে। সংস্থাটির মতে, বিশ্বের ১৮৪টি পর্যটনসমৃদ্ধ দেশের মধ্যে র্যাংকিংয়ে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬০ নম্বরে।
বৈশ্বিক এসব হিসাবের বাইরে দেশে পর্যটনের সঠিক পরিসংখ্যান নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। প্রতিবছর কোন দেশ থেকে কতজন পর্যটক আসছে, তারা কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে, কোন কোন গন্তব্যে যাচ্ছে—এমন কোনো তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সামগ্রিকভাবে পর্যটন খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এ খাতসংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) থেকে জাতিসংঘ পর্যটন সংস্থা ইউএনডাব্লিউটিওকে পাঠানো এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৬ সালকে পর্যটন বর্ষ ঘোষণা করার সময় পুলিশের বিশেষ শাখার উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) বলেছিল, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক আসে প্রায় ছয় লাখ ৪২ হাজার। ইউএনডাব্লিউটিও তাদের সদস্য দেশগুলোর পর্যটন পরিসংখ্যান নিয়ে প্রকাশনা বের করে থাকে। ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের তথ্য বাংলাদেশ ইউএনডাব্লিউটিওকে দিলেও ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান দিতে পারেনি। ২০১৭ সালের হিসাবও পাওয়া যায়নি।

শুধু তথ্যই নয়, দেশের পর্যটন খাতের কোনো পরিকল্পনাও নেই। বিটিবির গভর্নিং বডির সদস্য জামিউল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের পর্যটন চলছে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই। এতে না আছে ব্যবস্থাপনা, না আছে কোনো শৃঙ্খলা। যে যার মতো করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে এসে তা চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে এই শিল্পের জন্য পরিকল্পনামাফিক উন্নয়নকাজ করার কোনো সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, মহাপরিকল্পনার আশায় থেকে স্বল্প মেয়াদের পরিকল্পনাও থাকবে না তাও আবার পর্যটনের মতো এমন এক শিল্পের ক্ষেত্রে যা অবিশ্বাস্য অথচ এটাই সত্য। তবে, নিয়ম মানার নিয়মের মধ্যে পড়ে আটকে থাকা এই মহাপরিকল্পনার কাজটিকে গতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের গভর্নিং বডির ৩৬তম সভায় জোরালো তাগিদসহ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

জিডিপিতে পর্যটনের অবদান কেন বাড়ছে না জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আকর্ষণীয় গন্তব্য তৈরি করতে আমাদের যে বিনিয়োগ প্রয়োজন তা আমরা করতে পারছি না। সরকার পর্যটন খাতের যেসব সুবিধা দিয়েছে যা বাস্তবে পাওয়া কঠিন। আমাদের বহুমাত্রিক পর্যটন পণ্য আছে। আমাদের নদী, চা-বাগান, ঋতু, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে আমরা ব্যবহার করতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান যে ২.২ শতাংশ বলা হচ্ছে, তা আমার কাছে বেশি বলা হচ্ছে বলে মনে হয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছার কথা বলা হলেও বাস্তবে কোথাও কোনো উদ্যোগ নিয়ে বেসরকারি খাত এগিয়ে গেলে সেখানকার এমপি সাহেবরা তাতে ভাগ বসাতে চান। সহায়তার চেয়ে সরকারি পর্যায়ে যাতে জটিলতা সৃষ্টি না হয় সেটা দেখতে হবে। এখানে কম বিনিয়োগ হয়েছে, সে কারণে এই খাত নিয়ে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আমাদের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বিদেশি পর্যটকের দিকে তাকিয়ে না থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ভালোভাবে মিটিয়েই আমাদের পর্যটন খাতকে টিকে থাকতে হবে।’

আগামী বছরের জন্য রাজধানী ঢাকা শহরকে ‘ওআইসি পর্যটন নগরী’ ঘোষণা করা হয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে দশম ইসলামিক কনফারেন্স অব ট্যুরিজম মিনিস্টার্সের সভায় ঢাকা এই মর্যাদা লাভ করে। যাকে কাজে লাগাতে পারলে পর্যটন খাত থেকে আয় অনেক বাড়বে বলে আশা করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওআইসি সদস্য দেশের মধ্যে পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও প্রসারে একটি অভিন্ন প্লাটফর্ম, তথ্য বিনিময়, অভিজ্ঞতা শেয়ারিং ও সহযোগিতার মাধ্যমে পর্যটনের ক্ষেত্রে নতুন পরিকল্পনা প্রণয়নে এ সম্মেলন বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি দৃঢ় আশাবাদী।’

মন্ত্রী বলেন, সম্মেলন থেকে বাংলাদেশে ওআইসির একটি পর্যটন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন ও ঢাকাকে ট্যুরিজম সিটি হিসেবে ঘোষণা এসেছে যা আমাদের জন্য খুবই সম্মানের। এ ছাড়া ইসলামী প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণের জন্য ওআইসির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ১৩০ কোটি টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে যা আমাদের পর্যটন খাতকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে।

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2018/09/27/684652