২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৮:০৭

৯ বছরে সড়ক-মহাসড়কের পেছনে ৪৬ হাজার কোটি টাকা খরচ করে লাভ কী হল?

জাতীয় মহাসড়কের পেভমেন্টের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। যান চলাচলে বার্ষিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ‘ রোড পেভমেন্ট ডিজাইন গাইড-২০০৫’ অনুযায়ী এ আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। আর আঞ্চলিক মহাসড়কের পেভমেন্টের এ আয়ুষ্কাল (২০ বছর) নির্ধারণ করা হয়েছে যান চলাচলের ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হিসাবে। যদিও এক বছরেই আয়ুষ্কাল হারাচ্ছে নতুন নির্মিত জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক।

গত নয় বছরে নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। সড়ক মহাসড়কের পেছনে খরচ হওয়া ৪৬ হাজার কোটি টাকার ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ দেশের ২১ হাজার কিলোমিটার সড়কের মধ্যে অধিকাংশই চলাচলের অনুপযোগী বলে সওজের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে অনেক ক্ষেত্রে নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহার হচ্ছে। সড়ক নির্মাণের যে ‘কিউরিং পিরিয়ড’ থাকে, মানা হচ্ছে না তাও। এর ওপর সড়ক-মহাসড়কে চলছে সক্ষমতার অতিরিক্ত ভারী যানবাহন। যান চলাচলের অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধিও সড়ক-মহাসড়কের পেভমেন্টের আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক মহাসড়ক তৈরি এবং উন্নয়ন করা হচ্ছে। কিন্তু এগুলো কয়েক মাস যেতেই নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছয় কারণে টেকসই হচ্ছে না দেশের সড়ক মহাসড়ক। এর অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে- সংযোগ স্থাপন করতে গিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং অবকাঠামোয় অবহেলা, পানি নিষ্কাশনে নালার ব্যবস্থা না করা, নকশার ক্ষেত্রে আপস করা, ঠিকাদারসহ সবার মধ্যে মানসম্মত কাজ করার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠা এবং আমদানি করা নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার।

সূত্র জানায়, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে প্রতি বছর মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করছে সরকার। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের হিসাব বলছে, গত নয় বছরে নতুন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ ও উন্নয়নে ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও ব্যয় হয়েছিল ১৩ হাজার ৭০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ বিপুল পরিমাণ ব্যয়ের বিপরীতে গত অর্থবছরে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যয় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৭০৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
সারা দেশে সওজ অধিদপ্তরের আওতাধীন সড়কের পরিমাণ প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার। এ হিসাবে সর্বশেষ অর্থবছরে প্রতি কিলোমিটার সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে ৮ লাখ টাকা (৭ লাখ ৯৩ হাজার ৪৮২) ব্যয় করেছে অধিদপ্তর। ‘নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ’, ‘ধারাবাহিক (পিরিয়ডিক) রক্ষণাবেক্ষণ’ ও ‘জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ’ খাতে ব্যয় হয়েছে এ টাকা। এ তিন ধরনের রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ।

দেশের অন্যান্য মাহাসড়কের মতো প্রায় এক বছর ধরেই বেশ বেহাল দশায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে। সংস্কারের অভাবে ভঙ্গুর দশায় সড়কটির একাধিক পয়েন্ট। রাস্তার উপরে জায়গায় জায়গায় গর্ত আর ক্ষতবিক্ষত পেভমেন্ট (সড়কের উপরের আস্তরণ বা পিচ)। রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমের অনুপস্থিতি বা সংস্কার না হওয়ায় যাত্রীদের ভোগাচ্ছে সড়কটি।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ-ছাতক সড়কটি নির্মাণ করা হয় ২০০৫ সালে। নির্মাণের পর আর মেরামত হয়নি। দীর্ঘ ১৩ বছর সংস্কারহীন থাকায় সড়কটি এখন প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী।
একই অবস্থা টাঙ্গাইলের নাগরপুর-মির্জাপুর সড়কেরও। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ আর সংস্কার না হওয়ায় চরম আকার ধারণ করেছে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ। ঢাকা-সিলেট, কোম্পানীগঞ্জ-ছাতক কিংবা নাগরপুর-মির্জাপুরের মতো এ রকম অসংখ্য সড়ক রয়েছে সারা দেশে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রতিবেদনও বলছে, সারা দেশে ভাঙাচোরা দশায় রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার সড়ক। অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হলে এর পরিমাণ অনেকটাই কমিয়ে আনা যেত।
নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কথা বলা আছে অধিদপ্তরের ২০০৫ সালের সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ নির্দেশিকাতেও। নিয়ম অনুযায়ী, নির্মাণ শেষ হওয়ার পর থেকেই শুরু হবে রক্ষণাবেক্ষণ পিরিয়ড। এজন্য দেশের প্রতিটি সড়ক বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বরাদ্দ থাকে। সড়ক বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রতিদিন বিভিন্ন সড়ক পরিদর্শন করবেন। কোথাও সড়কের অবস্থা খারাপ দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে তা ঠিক করে দেবেন। মোটামুটি এ-ই হলো নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ বা রুটিন মেইনটেন্যান্সের কার্যাবলি।

বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগারের পরিচালক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, নির্মাণের পর যেকোনো সময় সড়ক ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এজন্য ‘ডিমান্ড রেসপন্ডিং মেইনটেন্যান্স’ করতে হয়। ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট (পিচ) যেদিন বানানো হবে, সেদিন থেকেই নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ দরকার। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো দরপত্রের প্রয়োজন পড়ে না। এসব মেরামতের জন্য নির্বাহী প্রকৌশলীর হাতে নগদ টাকা দেয়া হয়। বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে নির্বাহী প্রকৌশলীরা এ অর্থ দিয়ে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি কিনে শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, আমাদের দেশে সড়ক সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। এখানে প্রথমে সড়কে সামান্য ফাটল দেখা দিলে আমরা আমলে নিই না। সে ফাটল বড় হয়ে যখন ছোট গর্তে পরিণত হয়, তখনো কারো টনক নড়ে না। ছোট গর্ত বড় হয়ে যখন জনদুর্ভোগ তৈরি হয়, সে দুর্ভোগ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়; তখন আমাদের কর্মকর্তারা উদ্যোগী হন। প্রথমে যে সামান্য ফাটল দেখা দিয়েছিল, সেটা যদি তাৎক্ষণিকভাবে মেরামত করা হতো; তাহলে কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, গাফিলতি নয়, পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম। রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ চাহিদা ও প্রাপ্ত বরাদ্দ নিয়ে সম্প্রতি একটি তালিকা প্রকাশ করেছে সওজ অধিদপ্তরের মহাসড়ক উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ (এইচডিএম)। এতে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রয়োজন ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে বরাদ্দ হয়েছে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা। এইচডিএমের ২০১০-১৮ সাল পর্যন্ত চাহিদা ও বরাদ্দের চিত্র বিশ্লেষণ করে প্রতি বছরই বিস্তর ফারাক দেখা গেছে।
সড়ক নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিটুমিন। যদিও নিম্নমানের বিটুমিন ব্যবহারের বিষয়টি উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, মহাসড়কে ৬০/৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলেও তা অমান্য করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করছে ৮০/১০০ গ্রেডের বিটুমিন। নিম্নমানের এ বিটুমিন ব্যবহারের কারণে গরমের সময় তা গলতে শুরু করে। এ কারণে সড়কে গর্ত ও ফাটল দেখা দেয়, পেভমেন্টও উঠে যায়।

পেভমেন্টের আয়ুষ্কালের জন্য কিউরিং পিরিয়ডও গুরুত্বপূর্ণ। পেভমেন্ট নির্মাণের পর কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা কিউরিং পিরিয়ড রাখতে হয়। কিন্তু বিকল্প সড়ক না থাকায় তার আগেই যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় পেভমেন্ট।
সূত্র জানায়, সড়কের স্থায়িত্ব রক্ষায় ২০১২ সালে এক্সেল লোড নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। এ নীতিমালা অনুযায়ী, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের পণ্য পরিবহনের সর্বোচ্চ সীমা ২০ টন। আর প্রাইম মুভার, ট্রেইলারের পণ্য বহন ক্ষমতা ৩৩ টন। দেশে চলাচলরত দুই এক্সেলের ট্রাকের ক্ষেত্রে সামনের চাকায় লোড হবে সাড়ে পাঁচ টন ও পেছনের চাকায় ১০ টন। অর্থাৎ ছয় চাকার ট্রাকের সর্বোচ্চ ওজন বহন ক্ষমতা সাড়ে ১৫ টন। এর অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন করলে জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। তার পরও অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ হচ্ছে না, যা সড়কের আয়ুষ্কাল কমিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে সড়ক মেরামতের পর তার স্থায়িত্ব নিয়ে স¤¯্রতি এক সেমিনার হয় পরিকল্পনা কমিশনে। ঐ সেমিনারে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বলেন, ২১ হাজার কিলোমিটার রাস্তার নকশা ও ডাটাবেইজ করতে হবে। আমরা যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি পাচ্ছি তা অবকাঠামো থেকেই আসছে। তাই অবকাঠামোর স্থায়িত্ব রক্ষায় ঠিকাদারদের কাছ থেকে সড়কের লাইফ টাইম সনদ নেয়া প্রয়োজন।
রাস্তা নির্মাণে গতানুগতিক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সংস্কারমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমানে বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে গেছে। তাই বিটুমিনাস রাস্তা টেকসই হবে না। এজন্য কংক্রিটের রাস্তা করতে হবে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, সড়কের সংস্কারে বরাদ্দ থাকা উচিত। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে আবদার করছি, যাতে সংস্কার কাজে বরাদ্দ দেয়া হয়।
কংক্রিটের রাস্তা নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পরিকল্পনা সচিব মো. জিয়াউল ইসলাম বলেন, ওভারলোডের কারণে ব্রিজ ভেঙে গেলে তার ক্ষতিপূরণ সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকে নেয়া উচিত।সেজন্য আইন করতে হবে।
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় সড়ক গবেষণাগারের পরিচালক ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, টেকসই সড়ক অবকাঠামো পেতে হলে গুণগতমান নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। দেশ স্বাধীনের পর ২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা থেকে বেড়ে এখন ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এতদিন সংযোগে বেশি গুরুত্ব দেয়া হলেও এখন সময় এসেছে মানের দিকে বেশি নজর দেয়ার। এত বিশাল সড়ক নেটওয়ার্ক রক্ষণাবেক্ষণের চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
তিনি বলেন, এখন রাস্তা তৈরি করলে ফাউন্ডেশন দেয়া প্রয়োজন, যাতে অধিক লোড সহ্য করতে পারে। কেননা বর্তমানে ১৬ টনের জায়গায় ৪৭ থেকে ৫২ টন ওজনের ট্রাক চলাচল করে। এতে রাস্ত দ্রুত নষ্ট হচ্ছে।
বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়া বিবেচনা করে সড়ক অবকাঠামোর নকশা করা উচিত। গবেষক ও লেখক আবুল মকসুদ বলেন, যত টাকাই খরচ করি না কেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে শেষপর্যন্ত কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না।

 

http://www.dailysangram.com/post/347037