২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১:৩৯

থেমে নেই বিরোধী দলীয় ঐক্য দুর্বল করার বিভিষণী ষড়যন্ত্র ॥ প্রোপাগান্ডায় নতুন মাত্রা

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী চারদলীয় জোট গঠনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। মূলত এরপর থেকেই জোট ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতকে আলাদা করার জন্য চলে নানামুখি অপপ্রচার। এখনও তা থেমে নেই। এক পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর উপর চলে ভয়াবহ ক্রেকডাউন। একের পর এক জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। চলে গণগ্রেফতার। খুন, গুমের শিকার হয় নেতাকর্মীরা। এরপর শুরু হয় আরেক ধরনের প্রোপাগান্ডা। কখনো বলা হচ্ছে, জামায়াত কোনঠাসা হয়ে পড়েছে আবার কখনো বলা হচ্ছে, বিএনপি- জামায়াতের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে। আর এর সবগুলোই করা হচ্ছে সরকারের ইশারায়। এর কারণ হলো ভোটের হিসাব নিকাশ। যারা মনে করেছিল জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে সরিয়ে দেয়া হলেই দলটি শেষ হয়ে যাবে, তারা এখন দেখছে ঠিক উল্টো হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে জামায়াতের সমর্থন দিন দিন বাড়ছে। এটাই তাদের আতংকের কারণ। ঐক্যপ্রক্রিয়ার মধ্যে অপপ্রচারে নতুন মাত্রা দেয়া হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। দেশের প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ করেছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে জামায়াতে ইসলামী। এমনকি স্বাধীনতার আগেও স্বৈরাচার বিরোধী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জামায়াত শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। ষাটের দশকের শুরুতে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগসহ কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি (কপ), পরবর্তীকালের গণতান্ত্রিক আন্দোলন (পিডিএম), ডেমোক্র্যাটিক এ্যাকশন কমিটি (ডাক) প্রভৃতি সকল বিরোধী দলীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জামায়াত শামিল ছিল।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে যুগপৎ আন্দোলন : আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোট এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট কিছু কিছু যুগপৎ কর্মসূচি দিতে থাকে। ১৯৮৩ সালের ২৮ নবেম্বর ১৫ দলীয় জোট ও ৭ দলীয় জোট সচিবায়ল ঘেরাও কর্মসূচি দেয়। এ কর্মসূচিতে জনগণের তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার তার শাসন আরো দৃঢ় করে। বন্ধ করে দেয় রাজনৈতিক তৎপরতা। এই সময় জামায়াতে ইসলামীর লিয়াজোঁ কমিটি দুই নেত্রীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে গণতন্ত্রে উত্তোরণ সম্ভব নয় বলে জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। এই বক্তব্যের প্রতি তারা ইতিবাচক মনোভঙ্গি ব্যক্ত করেন। তখন থেকে ১৫ দলীয় জোট ও ৭ দলীয় জোটের সাথে জামায়াতে ইসলামীর লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে থাকে।
যুগপৎ আন্দোলন : ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট, বামদের ৫ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করার সিদ্ধান গ্রহণ করে। এর ফলে চাঙ্গা হয়ে উঠে এরশাদবিরোধী আন্দোলন। অনেক বিলম্বে হলেও জামায়াতে ইসলামীর কেয়ারটেকার সরকারের দাবি জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়। ১৯৯০ সালের ১৯ নবেম্বর পৃথক পৃথক সমাবেশ থেকে ৮ দলীয় জোট, ৭ দলীয় জোট, ৫ দলীয় জোট এবং জামায়াতে ইসলামী কেয়ারটেকার সরকারের রূপরেখা প্রকাশ করে। ১৯৯০ সালের ২৭ নবেম্বর দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। জারি করা হয় কারফিউ। ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙ্গে মিছিল করতে থাকে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ পদত্যাগ করেন। গঠিত হয় প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে দেশের প্রথম কেয়ারটেকার সরকার।
চারদলীয় জোট গঠন : ১৯৯৯ সনের ৩০ নবেম্বর ২৯ মিন্টো রোডে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আওয়ামী দুঃশাসন থেকে দেশকে উদ্ধার করার সংকল্প নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেন এবং একটি ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ : জোটবদ্ধভাবে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ই জোটবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করে চারদলীয় জোট। ২০০১ সনের ১লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকালে রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ। কেয়ারটেকার প্রধান ছিলেন বিচারপতি লতিফুর রহমান।
২০০১ সনের ১লা অক্টোবরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আকস্মিকভাবে চারদলীয় জোট ত্যাগ করেন। তবে নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ চারদলীয় জোটে থেকে যায়। এই নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ১৯৩টি আসন, আওয়ামী লীগ ৬২টি আসন এবং জামায়াতে ইসলামী ১৭টি আসন লাভ করে। সংসদের মহিলা আসনগুলো থেকে জামায়াতে ইসলামী ৪টি আসন লাভ করে।
ভোটের হিসাব নিকাশ : ভোটের হিসাব নিকাশে সব সময়ই সামনে ছিল জামায়াতে ইসলামী। বিশেষ করে অতীতের জাতীয় নির্বাচনগুলোতে জামায়াতে ইসলামী ছিল ক্ষমতায় যাওয়ার একটা ফ্যাক্টর। কেন না ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামী বিএনপিকে সমর্থন দেয়ার কারণে তারা ক্ষমতায় আসীন হয়। কিন্তু ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামী বিএনপিকে সমর্থন না দেয়ায় ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী চারদলীয় জোট গঠনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসে। চারদলীয় জোটের বিরোধীদের বিশ্লেষণ ছিল এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০০৬ সালের নির্বাচনেও এই জোট পুনরায় ক্ষমতায় আসবে। এ কারণেই সেই নির্বাচন হতে দেয়া হয়নি। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ১/১১ ঘটানোর মধ্য দিয়ে দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়া হয়।
এতো কিছুর পরও জামায়াতের রয়েছে সেই কর্মী, সমর্থক, জনসমর্থন। যার প্রতিফলন আমরা দেখেছি স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে। বিশেষ করে এরপর যেসব উপজেলা নির্বাচন, পৌর নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার সবগুলোতে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করে এবং বিজয়ীও হয়।
বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এসেই দেশ ও জাতিবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। দেশে গণতন্ত্রের চর্চার ক্ষেত্র ধীরে ধীরে সংকোচিত হতে থাকে। বিরোধীদলের সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে জামায়াতে ইসলামীর সভা সমাবেশ অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। ধীরে ধীরে ঘরোয়া বৈঠক বন্ধ করে দেয়া হয়। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে বানোয়াট অভিযোগ গ্রেফতার করা হয়। তারপরও নেতাকর্মীরা কর্মসূচি পালনে কোন ধরনের সন্ত্রাস বা ভায়োলেন্সের পথ বেছে নেয়নি। ২০০৯, ২০১০ ও ২০১১ সালে জামায়াতকে মাঠেই নামতে দেয়নি সরকার। ২০১১ সালের শেষ দিকে পুলিশের বাধা না মেনে রাজধানীতে মিছিল করে জামায়াতে ইসলামী।
২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের শাপলা চত্বরে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে সমাবেশ করে জামায়াতে ইসলামী। সে সমাবেশে পুলিশ বাধা দেয়নি বলে লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে সমাবেশ হলেও কোন ধরনের ভায়োয়েন্সের ঘটনা ঘটেনি। বরং সে সমাবেশে জামায়াতের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ফুল দিয়ে বরণ করার ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ববাসী।
থেমে নেই ক্রেকডাউন : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দকে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাবন্দী করে। দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলকে বাইরে রেখে পেশীশক্তির জোরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ‘ভোটারবিহীন’ নির্বাচন করে নিজ দলীয় ১৫৩ জন প্রার্থীকে বিনা ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করে। দেশে বিদেশে কোথাও এ নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এখন আরো একটি নির্বাচন সামনে এসেছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশেই ধর পাকড় চলছে। থানায় থানায় দেয়া হচ্ছে গায়েবী মামলা।
জামায়াতের উপর ক্রেকডাউন এখনও বন্ধ হয়নি। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর, সাবেক সংসদ সদস্য আ ন ম শামসুল ইসলামকে গত সোমবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আরেক নায়েবে আমীর সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে গায়েবী মামলা, গত ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গ্রেফতার করা হয়েছে সিলেট দক্ষিণ সাংগঠনিক জেলা শাখা জামায়াতের সেক্রেটারী ও সুরমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমান আহমাদসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ১৭ জন নেতা-কর্মীকে, গত ২০ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলা শাখা জামায়াতের আমীর সৈয়দ গোলাম সারোয়ার, দিনাজপুর উত্তর সাংগঠনিক জেলা শাখা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি তৈয়ব আলী, বায়তুলমাল সেক্রেটারি আতাউর রহমান ও ব্রাক্ষণবাড়ীয়া জেলার নাসির নগর উপজেলা শাখা জামায়াতের আমীর ছায়েদ আলী, আশুগঞ্জ উপজেলা শাখা জামায়াতের আমীর মোঃ শাহজাহান, সরাইল উপজেলা শাখা জামায়াতের সেক্রেটারি মোঃ এনাম খান এবং বায়তুলমাল সেক্রেটারি এডভোকেট মনিরকে। এভাবে সারাদেশেই চলছে গ্রেফতার অভিযান।
আসলে এ সবকিছুর মূলে রয়েছে সরকারের মূল্যবান লাভের চিন্তা। একদিকে জামায়াতকে জাতীয় ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার অব্যাহত চেষ্টা, জামায়াতকে দুর্বল করার অবিরাম প্রয়াস। জামায়াতকে জাতীয় ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে ভোটের হিসেবে জাতীয় ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত ও সরকার লাভবান হবে। আর যদি জামায়াতকে বিচ্ছিন্ন করা না যায় জাতীয় ঐক্য থেকে, তাহলে জামায়াতকে দুর্বল করা গেলে জাতীয় ঐক্যের ভোটের হিসাবে কিছুটা হলেও টান পড়বে। এসব হিসাব সামনে রেখে অভিজ্ঞমহল বলছেন, জাতীয় ঐক্য গঠনের সময়ে এর মধ্যে যারা বিভেদের কথা বলছেন তারা জাতীয় ঐক্যকেই দুর্বল করছেন।

http://www.dailysangram.com/post/346902-