২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১:৩১

প্রকল্পের চাপে ‘নাভিশ্বাস’ পরিকল্পনা কমিশনের

অনুমোদনের অপেক্ষায় শতাধিক প্রকল্প * তড়িঘড়ির কারণে বাস্তবায়ন পর্যায়ে অপচয়, অনিয়ম, দুর্নীতি ও গুণগত মান নিশ্চিত না হওয়ার আশঙ্কা বিশ্লেষকদের

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই প্রকল্প অনুমোদন এবং সংশোধনের হিড়িক পড়েছে। ইতিমধ্যেই প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার মাদ্রাসার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। আর অনুমোদন ও সংশোধনের অপেক্ষায় আছে শতাধিক প্রকল্প।
এগুলোর অধিকাংশই ‘ভোটার তুষ্টি বা নির্বাচনী প্রকল্প’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, তড়িঘড়ি করে অনুমোদন পাওয়া এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে সেগুলোর বাস্তবায়ন পর্যায়ে সংশোধনের নামে ব্যয় বাড়িয়ে সরকারি অর্থের অপচয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির সম্ভাবনা থাকছে। পাশাপাশি আছে কাজের গুণগত মান নিশ্চিত না হওয়ার শঙ্কা।
আগামী ডিসেম্বরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট এবং ১০ নভেম্বরের মধ্যে তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনা আছে। আর বিধান অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার পর নতুন কোনো প্রকল্প অনুমোদন নিষিদ্ধ। তাই তফসিলের আগেই উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন ও সংশোধন করাতে চাচ্ছে সবাই। এতে প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণে চাপ বেড়েছে। রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টদের।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, শতাধিক প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলো একনেকে উপস্থাপনের জন্য প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। আবার কোনোটি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অথবা অ্যাপ্রেইজাল সভা পর্যায়ে রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকল্পের প্রস্তাব আসা অব্যাহত আছে। এসব প্রকল্প দ্রুততম সময়ে অনুমোদন ও সংশোধন পেতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তদবির করছেন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও মেয়রসহ প্রকল্প পরিচালকরা।
এদিকে চলতি মাসের ১১ ও ১৮ তারিখে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এগুলোতে অনুমোদন পেয়েছে ৩৪টি প্রকল্প। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকেই ব্যয় করা হবে প্রায় সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। অনুমোদিত প্রকল্পের মধ্যে এমপিদের জন্য নেয়া মাদ্রাসা উন্নয়ন প্রকল্পও ছিল। শুধু এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নেই ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৯১৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মো. জিয়াউল ইসলাম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এডিপিতে রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট সম্পর্কিত ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বা এলজিইডির প্রকল্প সংখ্যা এমনিতেই বেশি। তাই এসব প্রকল্প বেশি অনুমোদনের জন্য আসছে। নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। সবাই চায় তাদের এলাকার প্রকল্প দ্রুত অনুমোদন পাক। এটা অপরাধের কিছু নয়, জনপ্রতিনিধিরা তো চাইবেই তাদের এলাকায় কোনো কাজ হোক। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বছরের এ সময়টায় এমনিতেই প্রকল্পের চাপ বেড়ে যায়। তড়িঘড়ি করলেও প্রকল্পের গুণগত মান ঠিক রাখা হচ্ছে।
সরেজমিন রোববার ও সোমবার পরিকল্পনা কমিশন ঘুরে দেখা গেছে, ভৌত অবকাঠামো বিভাগ এবং কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগে চাপ সবচেয়ে বেশি। কেননা রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্টসহ সরাসরি ভোটার আকৃষ্ট করার মতো প্রকল্পগুলো প্রক্রিয়াকরণ করে থাকে এ দুই বিভাগ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, যেহেতু নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হলে অনেক মন্ত্রীই বাদ পড়বেন, সেহেতু তারা চাচ্ছেন দ্রুত তাদের প্রকল্প অনুমোদন করাতে।
বর্তমানে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই একাধিক বৈঠক করতে হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব প্রকল্পের পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেগুলো অন্য সময় সংশোধিত হয়ে মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা কমিশনে আসতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগত। এখন সেগুলো সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সংশোধিত হয়ে ফেরত আসছে। ফলে একসঙ্গে অনেক প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণের চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রশ্ন হচ্ছে- যেসব প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, সেগুলো প্রকৃত জনকল্যাণের, নাকি ভোটার তুষ্টির জন্য। তড়িঘড়ি করে অনুমোদন দেয়া হলে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা যায় না। ফলে পরবর্তীকালে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়বে। এমনিতেই এই সমস্যা রয়েছে সেটি আরও প্রকট হবে। সেই সঙ্গে অনিয়ম ও দুর্নীতিরও আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে. মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, ভৌত অবকাঠামো এবং কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রকল্পগুলোতে রাজনৈতিক আগ্রহ বেশি থাকে। এক্ষেত্রে যারা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তারা জনগণের কাছে প্রকল্প অনুমোদনের কথা বলে তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারেন। তাই এই দুই বিভাগেই চাপ বেশি।
তবে সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা না হলে সঠিক মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। সরকারি অর্থের সঠিক ব্যবহার না হয়ে বরং অপচয় হতে পারে। তাই পরিকল্পনা কমিশনের উচিত মানের সঙ্গে আপস না করা। এক্ষেত্রে সচেতন না হলে প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ হবে না।
কমিশনের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত চার বছরে এমন চাপ সৃষ্টি হয়নি। নির্বাচন সামনে থাকায় সবাই চাচ্ছেন তাদের প্রকল্প অনুমোদন করাতে। স্বাভাবিকভাবেই সংসদ সদস্যরা তাদের এলাকার প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় নিয়মনীতিও মানতে নারাজ তারা। দ্রুত পাস করাতে পারলেই যেন বেঁচে যান। তবে প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনা করে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা হচ্ছে। যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটি আগে উপস্থাপন করা হবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, নির্বাচনের আগে আসনভিত্তিক কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া উচিত নয়, যেটি ভোটের ওপর প্রভাব পড়ে। এটা নেয়া হলে সেটি অনৈতিক হবে। তবে বিদেশে যেমন আইন রয়েছে নির্বাচনের কতদিন আগে এলাকাভিত্তক নতুন প্রকল্প নেয়া যাবে না। কারণ নির্বাচনের আগে নতুন প্রকল্প নেয়া হলে সরকারি দল বেশি সুবিধা পাবে।
এতে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ)’ থাকবে না- এমন বিবেচনায় এ রকম আইন করেছে ওইসব দেশ। কিন্তু আমাদের দেশে তো এ রকম আইন নেই। তাই আইনের সংস্কার করা প্রয়োজন। সরকারের উচিত হবে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখা। নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে- এ রকম প্রকল্প না নেয়াই উচিত।
সূত্র জানায়, একনেকে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘রুরাল কানেকটিভিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (আরসিআইপি)।’ এ প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৩৪টি জেলার ১৮০টি উপজেলায় সড়ক উন্নয়ন করা হবে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৬৬৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ হাজার ১৭২ কোটি ১৩ লাখ টাকা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ থেকে ২ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। প্রকল্পের আওতায় ২ হাজার ২১০ কিলোমিটার উপজেলা সড়ক, ৪৯৫ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক এবং ২৫০ কিলোমিটার সড়কে বৃক্ষরোপণ করা হবে। একনেকে অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)।
একইরকম আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে ‘উপজেলা ইউনিয়ন ও গ্রামসড়কে অনূর্ধ্ব ১০০ মিটার সেতু নির্মাণ’ এটি বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত ব্যয় ২ হাজার কোটি টাকা। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বর্তমানে অ্যাপ্রেইজাল সভা পর্যায়ে রয়েছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডের সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়ন এবং বাস বা ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে প্রস্তাবিত ব্যয় ১ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৯৮৩ কোটি ৯৭ লাখ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব তহবিল থেকে ২৪৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে।
আরও জানা গেছে, একনেকে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত আছে- সিরাজগঞ্জে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ ও ৫০০ শয্যার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্প (প্রথম সংশোধিত), এটির ব্যয় বাড়ছে ২৪৭ কোটি টাকা। ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (বাংলাদেশ), এটি বাস্তবায়নে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়ছে ১ হাজার ১৯৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) দ্বিতীয় পর্যায় (দ্বিতীয় সংশোধিত) প্রকল্প, এটির মেয়াদ বাড়ছে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই বছর এবং ব্যয় বাড়ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। সুমিতোমো ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে ভূমি অধিগ্রহণ ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম প্রকল্প, এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ২৭০ কোটি ৮৮৪ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি ও আড়াইহাজার উপজেলায় হালদা নদী ও ধুরং খালের তীর সংরক্ষণ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫৬ কোটি টাকা। যাত্রাবাড়ী (মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার)-ডেমরা সুলতানা কামাল সেতু মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প, এটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
এ ছাড়া প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় উত্থাপন করা হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রকল্প। পিইসির ছাড় পেলেই অনুমোদনের জন্য একনেকে উপস্থাপন করা হবে প্রকল্পগুলো। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বহুলেন সড়ক টানেল নির্মাণ প্রকল্প। এক্ষেত্রে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ছে ১ হাজার ৯৪৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। মেঘনা নদীর ভাঙন থেকে ভোলা জেলা সদর উপজেলার রাজপুর ও একটি ইউনিয়ন রক্ষার্থে তীর সংরক্ষণ প্রকল্প। এটি সংশোধন করে প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে ৬৪ কোটি টাকা।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/94219/v