২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৯:০১

সক্ষমতা ছাড়াই ট্রানজিট

ভারতকে চট্টগ্রাম-মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমোদনে লাভালাভ

ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারে বাংলাদেশের লাভালাভের বিষয়গুলো পুনরায় সামনে এসেছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এ ব্যাপারে চুক্তির খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। এতে বলা হয় এখন বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চলমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক সুদীর্ঘ করার উদ্দেশ্যে এগ্রিমেন্ট অন দা ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড ইন্ডিয়া খসড়ায় অনুমোদন দেওয়া হল। অর্থাৎ ভারতের মালামাল বাংলাদেশের বন্দর ও ভূমি ব্যবহার করে ভারতে যাবে। আবার বিপরীতে রফতানিও হবে।

পোর্ট-শিপিং খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম ও মংলা উভয় বন্দরে অবকাঠোমো সুবিধার অভাব রয়েছে। অথচ প্রয়োজনীয় সক্ষমতা না থাকা সত্তে¡ও ভারতকে দেয়া হচ্ছে ট্রানজিট বা করিডোর সুবিধা। তা আর্থিক, বৈষয়িক, কৌশলগত কোনো দিক দিয়েই সুফল বয়ে আনবে না। বরং নানামুখী অনাহুত সমস্যা তৈরি করবে।

ভারতের ‘দি সেভেন সিস্টার’ হিসেবে পরিচিত সাতটি রাজ্য স্থলাবদ্ধ। ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে সেসব রাজ্যে যেতে হয় অনেক দীর্ঘ পথে ঘুর। এর জন্য বাংলাদেশের বন্দর ও ভূখন্ড (স্থল ও রেলপথ) ব্যবহার করে সেখানে পণ্যসামগ্রী পরিবহনের জন্য ভারত দীর্ঘদিন যাবত পিড়াপীড়ি করে আসছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীমহল বলছেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭টি রাজ্যে (আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল) বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা, কৃষি-খামারে উৎপাদিত একশ’রও বেশি ধরনের নিত্য, ভোগ্য ও সেবাপণ্যের ব্যাপক বাজার চাহিদা রয়েছে। স্বল্প দূরত্বে অনায়াসেই সেসব রাজ্যে পণ্যসামগ্রী রফতানি সম্ভব। সেখানকার জনগোষ্ঠি সুলভেই কিনতে পারে বাংলাদেশের গুণগত উৎকৃষ্ট মানের পণ্য।

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের পণ্যসামগ্রী সেসব রাজ্যে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর দিয়ে যখন পরিবাহিত হবে বাংলাদেশের রফতানি সম্ভাবনা আর অবশিষ্ট থাকবে না। তাছাড়া চুক্তির খসড়া অনুযায়ী বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে মালামাল পরিবহনের জন্য গ্যাট নীতি অনুসারে শুল্ক বা কর ব্যতীত শুধুই চার্জ-ফি ও পরিবহন খরচ আদায় করা হবে।

দীর্ঘদিন যাবত ভারতের চাপিয়ে দেয়া শুল্ক ও অশুল্ক বাধা-বিপত্তি এবং বিভিন্ন ধরনের জটিলতার কারণেই ভারতের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ৭টি রাজ্যসহ প্রতিবেশী দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রী রফতানির সহজ সুযোগ আটকে আছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে ভারতের ওপর দিয়ে স্থলপথে পণ্য আমদানি-রফতানির ন্যূনতম সুযোগ প্রদানে সহযোগিতার বদলে গড়িমসি করে আসছে। এ কারণে দুই প্রতিবেশী স্থলাবদ্ধ নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের হরেক পণ্য রফতানির বিরাট সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। নেপাল ইতোমধ্যে তার অপর প্রতিবেশী চীনের চারটি বন্দর ব্যবহারের লক্ষ্যে চুক্তি করেছে। অন্যদিকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভা যে চুক্তির খসড়া অনুমোদন করেছে তা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক। এখানে অপর দুই প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত নয়। শুধু বলা হয়েছে চুক্তিতে একটি প্রভিশন রাখা আছে যাতে নেপাল ও ভুটান ‘ইচ্ছা প্রকাশ করলে’ যুক্ত হতে পারবে।

এই চুক্তির খসড়া অনুমোদন প্রসঙ্গে ইস্ট-ডেল্টা ইউনিভার্সিটির (ইডিইউ) ভাইস চ্যান্সেলর প্রবীণ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ প্রদান ভালো উদ্যোগ। তবে তার আগে দেখতে হবে আমাদের সেই সামর্থ্য ও সক্ষমতা আছে কি না। নিজেদের আমদানি ও রফতানি মালামাল হ্যান্ডলিং করার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধার ঘাটতি রয়ে গেছে। তাই বন্ধুকে সুবিধা দিতে গেলে বন্ধুর কাছে নিজের পাওনার বিষয়গুলো নিয়েও চিন্তা করতে হবে। আমাদের পর্যাপ্ত সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউজিসি অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের মতে, এই চুক্তি আরও আগে হওয়া উচিৎ ছিল। আমাদের বন্দর সুবিধা সেল (বিক্রয়) করার বিনিময়ে আয় বৃদ্ধি পাবে। ভারতও তার ভূমিবেষ্টিত রাজ্যগুলোতে সহজে পণ্য নিয়ে যেতে পারবে। তিনি বলেন, বে-টার্মিনাল এবং কর্ণফুলী টানেল নির্মিত হলে চট্টগ্রাম আরো সম্প্রসারিত হবে। নতুন পায়রা বন্দর দিয়েও ভারত মালামাল আনা-নেয়া করতে পারবে। তখন আর অবকাঠামো ও সক্ষমতায় ঘাটতি থাকবে না।

ইতোমধ্যে চিটাগাং চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বারসহ ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাগণ ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য সরকারের চুক্তির খসড়া অনুমোদনের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

এদিকে ট্রানজিট বা করিডোরের মাধ্যমে বিশাল পণ্যভার বহনের মতো সক্ষমতা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের নেই। দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি-রফতানি পণ্যের স্রোত সামাল দিতে গিয়েই উভয় সমুদ্র বন্দরকে হিমশিম অবস্থায় পড়তে হয় সারা বছর। গত দশ বছরের গড় হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিংয়ের চাপ ও চাহিদা বার্ষিক ১৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর চট্টগ্রাম বন্দরে ২৮ লাখ ৮ হাজার ৬শ’ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়। মোট ৯ কোটি ২৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন আমদানি ও রফতানি পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। বন্দরে নতুন কোনো টার্মিনাল ও বার্থ গত এক যুগে নির্মিত হয়নি। জেটি-বার্থ, ইয়ার্ড-শেড এবং ভারী যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতায় অনেক সময়েই কন্টেইনার ও জাহাজের বেসামাল জট সৃষ্টি হয়। মংলা বন্দরে দেশের সিংহভাগ মোটর গাড়ি এবং দক্ষিণাঞ্চলমুখী বিভিন্ন মালামাল আমদানি ও মজুদ রাখার ক্ষেত্রে স্থান সঙ্কুলান কঠিন হয়ে পড়েছে। মংলায় জেটি-বার্থ ও যান্ত্রিক সরঞ্জাম অপ্রতুল।

আঙ্কটাড রুলস্ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক পোর্ট-শিপিং কনভেনশন ও নীতিমালা অনুযায়ী কোনো সমুদ্র বন্দর স্বাচ্ছন্দে পরিচালনার জন্য অবকাঠামো সুবিধার কমপক্ষে ৩০ ভাগ খালি বা বাড়তি থাকা অপরিহার্য। চট্টগ্রাম বন্দরে বছরের বেশিরভাগ সময়েই কন্টেইনারসহ সব ধরনের পণ্যের চাপ বজায় থাকে।

অন্যদিকে ভারত আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বছরে প্রায় ৫শ’ কোটি বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী আমদানি করছে তার বিভিন্ন বন্দর দিয়ে। এই পণ্য প্রবাহের একটি ছোট একাংশও যদি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে যায় তাহলে উভয় বন্দরের স্বাভাবিক কর্মকান্ড মুখ থুুবড়ে পড়বে। তাছাড়া দেশের সড়ক-মহাসড়ক অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। কেননা বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়ক অত্যধিক ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভারী যানবাহন বিশেষত কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, ট্রেলার চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য এক্সেল লোড ব্যবহার করতে হচ্ছে।

বঙ্গোপসাগরের কোলে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় নিরাপদ পোতাশ্রয় ঘিরে হাজার বছর পূর্বে গড়ে ওঠা চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর হলেও মূলত এটি ‘ফিডার পোর্ট’। অর্থাৎ জোয়ার-ভাটার নির্দিষ্ট রুটিনে চলছে জাহাজ আসা-যাওয়ার সিডিউল। বৃহাদাকার জাহাজবহরকে বহির্নোঙরে অবস্থান করে আমদানি মালামাল লাইটারিং পদ্ধতিতে খালাস করতে হয়।

https://www.dailyinqilab.com/article/155477