২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮, মঙ্গলবার, ৮:৫৭

আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি

আইএমএফ’র প্রশ্নের মুখে পড়তে যাচ্ছে সরকার

ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে বাস্তবায়নের অগ্রগতি, ফারমার্স ব্যাংক, ব্যাংক খাতের বর্তমান পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে ২৬টি প্রশ্ন অর্থ মন্ত্রণালয়ে * রোববার ৫ দিনের সফরে আসছে প্রতিনিধি দল

ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটে বাস্তবায়নের অগ্রগতি, ফারমার্স ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সরকার। ইতিমধ্যেই এ সংক্রান্ত ২৬টি লিখিত প্রশ্ন পাঠিয়েছে সংস্থাটি।

আগামী রোববার ৫ দিনের সফরে আইএমএফের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসছে। ওই সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করবে প্রতিনিধি দলটি। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

সূত্র জানায়, সঞ্চয়পত্রের সুদ বেশি দিতে গিয়ে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কিনা, বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো ধরনের বিধিবিধানের সংস্কার হয়েছে কিনা- এ দুটি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইবে আইএমএফ। এছাড়া বাংলাদেশকে আরও যেসব বিষয়ে মুখোমুখি হতে হবে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- রোহিঙ্গাদের কারণে অর্থনীতিতে গত অর্থবছরে কোনো প্রভাব পড়েছে কিনা এবং আগামী অর্থবছরে কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা আছে কিনা।

পাশাপাশি চলতি অর্থবছরে বাজেটে রাজস্ব আদায়ে কোন খাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে এবং গত বাজেট কাটছাঁট করার মূল কারণ এবং বর্তমান বাজেট বাস্তবায়নের সর্বশেষ অগ্রগতির বিষয়ে নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে সরকারের সংশ্লিষ্টদের।

সূত্র জানায়, প্রতিনিধি দলের এই সফরের আগে আইএমএফ’র ঢাকা অফিস থেকে বাংলাদেশে অর্থনীতির সর্বশেষ অবস্থা জানতে ২৬টি প্রশ্নের একটি তালিকা অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদারের কাছে পাঠিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে অর্থনীতির সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

জানতে চাইলে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান সোমবার যুগান্তরকে বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতি দেখতে চায়। কোন খাতে ভালো হচ্ছে, কোনো খাতে মন্দ হচ্ছে- এগুলো জানতে চায় সংস্থাটি। মূলত এটি তাদের রুটিন বৈঠক। ঋণ দেয়ার বিপরীতে আর্থিক খাতের অগ্রগতি জানতে তারা সফরে আসছে।

সূত্র মতে, এবার ব্যাংকিং খাতের ওপর আইএমএফ’র বেশি দৃষ্টি থাকবে। সংস্থাটির প্রশ্নের তালিকায় অধিকাংশই হচ্ছে ব্যাংকিং খাত নিয়ে। গুরুত্ব পাওয়ার আরও একটি কারণ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে বেশকিছু পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদের হার একক অঙ্কে নামিয়ে আনার ঘোষণা ও বাস্তবায়ন এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ। এসব বিষয়ের সর্বশেষ অগ্রগতিও জানতে চাওয়া হবে।

অর্থ সচিবের কাছে পাঠানো আইএমএফ’র প্রশ্ন সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংক (বিএবি) ব্যাংক ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি আমানতের সুদের হার ৬ শতাংশ নির্ধারণ করে স্প্রেড ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে রাখা হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক কিভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছে তা জানতে চাওয়া হবে। পাশাপাশি ব্যাংক ঋণ ও আমানতের সুদের হার হ্রাস করায় ব্যাংকিং খাতের উন্নয়ন এবং মুনাফায় কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে কিনা সেটিও জানতে চাইবে সংস্থাটি।

আইএমএফ’র চিঠিতে আরও যেসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নের সর্বশেষ অবস্থা কি, ব্যাংকিং খাতের উচ্চ ঝুঁকি এখন কি স্থিতিশীল, ফারমার্স ব্যাংকের সর্বশেষ অবস্থা কি এবং ব্যাংকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে কিনা, ব্যাংকিং খাতে তারল্যের অবস্থা এবং বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের সর্বশেষ অবস্থা।

অর্থ সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে আইএমএফ বলেছে, আগামী অর্থবছরে নতুন সরকার আসবে। ফলে ওই অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে কি ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। নতুন অর্থনীতি এবং রফতানির বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে প্রত্যাশা কি- এসব বিষয়েও জবাব চাওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন তুলবে গত বছরে রাজস্ব আয়ের অর্জন নিয়েও। জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছর শেষে তা কাটছাঁট করা হয় ২৮ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা। ফলে সংশোধিত রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। এদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট কাটছাঁট করা হয় ২৮ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। এই বাজেট কাটছাঁটের মূল কারণ জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। তবে সংশোধিত বাজেটের আকার ছিল ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। যদিও ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট বছরের শুরুতে ঘোষণা করা হয়।

জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বেশি সুদ গুনতে হচ্ছে সরকারকে। সংস্থাটি জানতে চাইবে বেশি সুদ পরিশোধের কারণে সঞ্চয়পত্র ইস্যুতে কোনো ধরনের প্রভাব পড়ছে কিনা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের জুলাই থেকে গত এপ্রিল এই দশ মাসে জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয় ১৬ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা।

কিন্তু দেখা গেছে, এর আগের দশ মাসে সঞ্চয়পত্রের ঋণের সুদ বাবদ ১২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। এ খাতে সুদ পরিশোধ ব্যয় বেড়েছে ২৭ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ব্যাংকবহির্ভূত খাতের (সঞ্চয়পত্র) ঋণের সুদ ব্যয় বেড়েছে মূলত সঞ্চয়পত্র স্কিমের অস্বাভাবিক বিক্রি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকার কারণে। গত জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এটি বাজেটের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৯১ শতাংশের সমান।

আইএমএফ’র চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমান বাংলাদেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) টাকা ব্যয়ের গতি দেশটির আমদানি ব্যয়ের চেয়ে কম। এতে দেশের মূল্যস্ফীতিতে কোনো ধরনের প্রভাব পড়ছে কিনা। পাশাপাশি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে কোনো ধরনের প্রভাব পড়েছে কিনা।

ওই চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৪ দশমিক ৯ শতাংশ ঘাটতি রেখে নতুন বাজেটের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্য গত অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি এডিপির আকারও বড় করা হয়েছে। এই আকার বাড়ানোর পেছনে প্রধান কারণ কি। পাশাপাশি এটি শেষ পর্যন্ত ঘাটতি বাজেট বাড়িয়ে দেবে কিনা সেটিও জানতে চাওয়া হয়।

আইএমএফ আরও বলেছে, চলতি বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এই রাজস্ব প্রবৃদ্ধির প্রধান কোন খাত থেকে বেশি আসবে। এমনিতে চলতি অর্থবছরে আমদানির প্রবৃদ্ধি কম ধরা হয়েছে। এতে শেষ পর্যন্ত রাজস্ব আয়ে কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কিনা।

এছাড়া চলতি এবং আগামী অর্থবছরে রোহিঙ্গা সংকট কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে কিনা বা পড়ছে কিনা তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অধিক পণ্যমূল্য আগামী অর্থবছরে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে কিনা। বিশেষ করে জ্বালানি তেলে নতুন করে ভর্তুকি দেয়া হবে কিনা- সেটিও জানতে চেয়েছে আইএমএফ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/93858